দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্প্যানিশ ভাষার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অপরাজিত চট্টোপাধ্যায় এখন রীতিমতো ব্যস্ত। কাতার বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর থেকে তার কাছে বারবার আর্জেন্টিনার রেডিও ও টিভি চ্যানেলগুলো থেকে ফোন আসছে একটাই প্রশ্ন নিয়ে, কেন বাঙালিরা আর্জেন্টিনাকে এইভাবে সমর্থন করছে?

আর্জেন্টিনার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কাছে এটি রীতিমতো অবাক করার মতো ঘটনা। বেশ কয়েকটি আর্জেন্টাইন বেতার ও টিভি চ্যানেল অপরাজিতের সঙ্গে একাধিক লাইভ করেছে এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে। এই কারণে আর্জেন্টিনার ম্যাচ থাকলেই অপরাজিত ব্যস্ত হয়ে পড়েন বাঙালিদের আর্জেন্টিনা-প্রীতির ব্যাখ্যা দিতে।

অর্জেন্টিনার মূল ভাষা স্প্যানিশ; আর ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) স্প্যানিশ ভাষা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন অপরাজিত চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘ তিন দশক ভারতের এই প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্প্যানিশ পড়িয়েছেন বাঙালি এই অধ্যাপক। আর্জেন্টিনা ও স্পেনের দূতাবাসের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে তার।

ফলে এই যোগসূত্র ধরেই তার কাছে এই ধাঁধার সমাধানে তৎপর হয়েছে আর্জেন্টিনার রেডিও ও টিভি চ্যানেলগুলো। শুক্রবার গভীর রাতে আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ডসের ম্যাচ। তার আগে বৃহস্পতিবারও আর্জেন্টিনার একটি রেডিওর সঙ্গে কথা বলেছেন অপরাজিত। তাছাড়া আর্জেন্টিনা সম্পর্কে তার জ্ঞান ও আগ্রহ এবং স্প্যানিশ ভাষায় পান্ডিত্য দেখে বছর সাতেক আগে তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্বও দিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার এই ফুটবলপ্রেমী দেশটি।

অপরাজিত চট্টোপাধ্যায়

জার্মান সংবাদামধ্যম ডয়চে ভেলেকে অপরাজিত বলেন, ‘আসলে এত বাঙালি আর্জেন্টিনার সমর্থক এবং আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিয়ে, পতাকা লাগিয়ে, পুরো রাস্তা রাঙিয়ে দিয়ে, ম্যারাডোনা, মেসিদের ছবি এঁকে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করে দেখে ওরা অবাক। ভারত ও বাংলাদেশকে বাদ দিলে বিশ্বের কোথাও কোনো দেশের এত মানুষ আর্জেন্টিনার জন্য গলা ফাটায় না।  তাই ওদের এই অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক।’

অপরাজিত জানান, কাতারে বিশ্বকাপ ২০২২ টুর্নামেন্ট শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার পাঁচটি রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

ডয়েচে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘বাঙালি বলতে আর্জেন্টিনার মিডিয়া ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের বাঙালির কথা উল্লেখ করে। আর বংলাদেশের কাগজ আমি নিয়মিত পড়ি। সেই সূত্রে আর্জেন্টিনা নিয়ে  বাংলাদেশের উন্মাদনার কথাও আমার জানা।

‘আর আমার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরপাড়া এলাকায়। সুতরাং কলকাতার খবর তো আমার মুখস্ত থাকবেই।’

২০২২ সালের জনগণনা অনুসারে আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যা হলো চার কোটি ৭৩ লাখ।  ভারত ও বাংলাদেশের আর্জেন্টিনার সমর্থক বাঙালির সংখ্যা এর দ্বিগুণ হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। ফলে আর্জেন্টিনার মিডিয়া যে স্প্যানিশ জানা, ফুটবলের হাল-হকিকত নিয়ে ওয়াকিবহাল একজনকে খুঁজে বের করে ধাঁধার উত্তর খুঁজতে চাইবে সেটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এমনকী আর্জেন্টিনার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম অপরাজিতের কাছে এটাও জানতে চেয়েছে, ভারতে বাঙালি ছাড়াও কেরলের মানুষ কী করে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করছে?

‘আমি ওদের বুঝিয়েছি, ম্যারাডোনার জন্যই বাঙালিরা এইভাবে আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়েছে। তার আগে সিংহভাগ বাঙালিই ব্রাজিলকে সমর্থন করত। কিন্তু ১৯৮৬ সাল থেকে ম্যারাডোনা বাঙালিদের কাছে ফুটবল-ঈশ্বরের মতো। সেই থেকে আর্জেন্টিনার সমর্থক বাঙালিদের একটা বড় অংশ। ম্যারাডোনার পর এখন তারা মেসির ভক্ত। ম্যারাডোনা, মেসির জন্য সাধারণ বাঙালির মনে আর্জেন্টিনার প্রতি দুর্বলতা রয়েছে।’

বিশ্বকাপের আসর শুরু হলেই কলকাতা ও ঢাকা, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ সেজে ওঠে সাদা-নীল রংয়ে। যত রাতই হোক, টিভির সামনে চোখ থাকে তাদের। দুই দেশে বিভিন্ন মহল্লায় বিশাল  স্ক্রিনে আর্জেন্টিনার খেলা দেখেন সব বয়সি নারী-পুরুষ।

অপরাজিত বলেছেন, ম্যারাডোনা কলকাতায় এসে দূর্গাপূজার উদ্বোধন করেছেন। একটি আবাসনের উদ্বোধন করেছেন। শিশুদের সঙ্গে খেলেছেন। ফলে ম্যারাডোনাকে নিয়ে কলকাতার মুগ্ধতা বেড়েছে। আর মেসিও কলকাতায় এসে দেখে গেছেন তাকে নিয়ে উন্মাদনার পরিমাণ কতটা।

ফুটবল নিয়ে আবেগ, ম্যারাডোনা, মেসিদের নিয়ে আবেগ এবং তার জেরে আর্জেন্টিনা নিয়ে বাঙালিদের আবেগ সে দেশের মিডিয়া কতটা ধরতে পারবে জানা নেই, তবে ঘটনা হলো, তারা যে আর্জেন্টিনা নিয়ে বাঙালিদের আবেগের মূলে যেতে চাইছে, এটাই বা কম কীসের!

এসএমডব্লিউ