২০২২ সাল ইতিহাসের পাতায় এমন একটি বছর হিসেবে লেখা থাকবে; যখন অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর প্রাণ হারানোর হাহাকার চলেছে

২০২২ সাল ইতিহাসের পাতায় এমন একটি বছর হিসেবে লেখা থাকবে; যখন মৃত্যুর ঢেউ চলেছে বিশ্বজুড়ে। একদিকে করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্বে লাখ লাখ সাধারণ মানুষের প্রাণ গেছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় কয়েকজন প্রধানেরও জীবনের অবসান ঘটেছে অনেকটা আকস্মিকভাবেই। ব্রিটেন হারিয়েছে রানিকে, জাপান হারিয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। রাজনীতিতেও বিদায় ঘটেছে অদক্ষ ও কলঙ্কিত নেতাদের। প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা হয়েছে বছরের বড় বড় সব পরিবেশ সম্মেলনে। ইউরোপে জেঁকে বসেছে ইতিহাসের বিধ্বংসী এক যুদ্ধ; যার অবসান এখনও সুদূরে।

বছরের প্রধান প্রধান আলোচিত কিছু ঘটনা...

• ইন্দোনেশিয়ার মালাংয়ে পদদলন

গত ১ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব জাভা প্রদেশের মালাং শহরের কাঞ্জুরুহান স্টেডিয়ামে এক ফুটবল ম্যাচের সমাপ্তি ঘটে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। ম্যাচ শেষ হওয়ার সাথে সাথে হাজার হাজার সমর্থক মাঠে ঢুকে পড়েন। বেশিরভাগই নিজ দলের হারে হতাশা প্রকাশ করতে মাঠে নামেন। পুলিশের সদস্যরা লাঠিপেটা করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করে।

এ সময় মাঠের চারদিক থেকে পানির বোতল, স্টেডিয়ামের চেয়ার ভেঙে পুলিশকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করতে শুরু করেন দর্শকরা। দাঙ্গার শঙ্কায় টিয়ার গ্যাস ছুড়ে মাঠ থেকে লোকজনকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করে পুলিশ। আতঙ্কিত লোকজনের ছোটাছুটিতে পুরো স্টেডিয়ামজুড়ে বিভৎস পরিস্থিতি তৈরি হয়। রাতের শেষের দিকে পদদলনে মালাংয়ের ওই স্টেডিয়ামে ১৩৩ জনের প্রাণহানি ঘটে।

পদদলনে মালাংয়ের স্টেডিয়ামে ১৩৩ জনের প্রাণহানি ঘটে

• সিউলে পদদলনে দেড় শতাধিক মৃত্যু

২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় হ্যালোইন উৎসব বন্ধ ছিল। এরপর এবছরই প্রথম এই উৎসব হয়, যেখানে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা ছিল না।

‘মৃত আত্মাদের স্মরণে’ প্রতিবছর অক্টোবরের শেষে হ্যালোইন উৎসব হয়। গত ২৯ অক্টোবর দেশটির রাজধানী সিউলে খ্রিষ্টানদের অন্যতম প্রধান এই উৎসব উদযাপনের অনুষ্ঠানে পদদলনে ১৫৮ জনের প্রাণহানি ঘটে।

সিউলের ইথেওন শহরে হ্যালোইন উৎসবে ১ লাখের বেশি মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। যাদের বেশিরভাগের বয়সই ছিল ২০ এর ঘরে। ওই দিন তরুণ বয়সীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছিল ইথেওন। ঘটনার দিন সকাল থেকে ইথেওনে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী উৎসবে মেতে উঠতে শুরু করে। কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে সেটি প্রচণ্ড জনসমুদ্রে রূপ নেয়।

স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ইথেওনের পরিস্থিতি বিপজ্জনক রূপ নেয়। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে জরুরি নম্বরে ফোন করে লোকজন সেখানকার সরু ও সংকীর্ণ রাস্তায় জড়ো হওয়া হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার অনুরোধ জানায়। কিন্তু পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। ইথেওন জেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় সব নাইটক্লাব আর বারের সরু গলিতে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়।

৫ মিটার চওড়া আর ঢালু গলিটি দ্রুত মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়। রাত ১০টা নাগাদ গলিতে মানুষ মারা যেতে থাকে। অনেক চেষ্টার পর উদ্ধারকারীরা আহত ও অচেতন লোকজনকে গলি থেকে টেনে বাইরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাতের শেষে ইথেওন থেকে ১৫৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যদিও আরও সাড়ে ৩০০ জনের বেশি মানুষ নিখোঁজ আছেন বলে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে সেই সময় জানানো হয়।

অনেকেই ধারণা করেছিলেন, ইউক্রেনের পতনের মধ্য দিয়ে দ্রুতই এই যুদ্ধের হয়তো অবসান ঘটবে

• ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশি ইউক্রেনে রাশিয়ার শত শত ট্যাংক ঢুকে পড়ে। ইউক্রেনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিশেষ সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশের পর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, দেশটির পতনের মধ্য দিয়ে দ্রুতই এই যুদ্ধের হয়তো অবসান ঘটবে।

রাশিয়ার জেনারেলরাও সৈন্যদের বলেছিলেন, ইউক্রেনে এই অভিযান ‘পার্কে হাঁটা’র মতোই হবে। এমনকি পশ্চিমের সামরিক বিশ্লেষকরাও কয়েকদিন বা সপ্তাহের মধ্যে কিয়েভের পতন হবে বলে আশাপ্রকাশ করেছিলেন।

>> আরও পড়ুন: কেন ইউক্রেনে আক্রমণ, কী চান পুতিন?

কিন্তু ১০ মাস পরও ভ্লাদিমির পুতিনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ চলছে। ইউক্রেনের কিছু অঞ্চলে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে রুশ সৈন্যরা। কোনও পক্ষই এই যুদ্ধে ছাড় না দেওয়ার অঙ্গীকারে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই যুদ্ধ সম্ভবত ২০২৩ সালেও চলবে।

ক্রেমলিন বলেছে, কিয়েভে মস্কোর সব ধরনের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। অন্যদিকে কিয়েভ বলেছে, ২০১৪ সালের ক্রিমিয়াসহ চলমান যুদ্ধে দখল করা ইউক্রেনের সব অঞ্চল থেকে রাশিয়ার সৈন্যদের বিতাড়িত না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে ইউক্রেন।

রোববার রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল রোশিয়া-১ এ প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে পুতিন বলেন, ‘আমরা গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের সাথে আলোচনা করতে প্রস্তুত। তবে এটি পুরোপুরি তাদের ওপর নির্ভর করছে। আমরা আলোচনার বিষয়টি নাকচ করছি না, তারা করছে।’

• বিশ্ব নেতাদের শেষ বিদায়

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন মুকুটধারী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গত ৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় বিকেলে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্যালেসে ৯৬ বছর বয়সে মারা যান। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটেনের সিংহাসনে আসীন ছিলেন ৭০ বছর। তার সিংহাসনে আরোহনের ৭০ বছরে ব্রিটেনে ১৫ জন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন।

২৭ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালের ২ জুন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে মুকুট পরেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। বিশ্বব্যাপী ২ কোটির বেশি মানুষ টিভিতে ওই অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখেছিলেন। অনেকেই তখন প্রথমবারের মতো সরাসরি টিভি অনুষ্ঠান দেখছিলেন।
 
পরবর্তী কয়েক দশকে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হ্রাস পায় এবং ১৯৬০-এর দশকে ব্রিটিশ সমাজে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে।
 
• ঘাতকের বুলেটে শিনজো আবের মৃত্যু

গত ৮ জুলাই জাপানের ইতিহাসের কলঙ্কিত একটি দিন। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর নারার একটি ট্রেন স্টেশনের বাইরে অল্প কিছু মানুষের রাজনৈতিক সমাবেশে বক্তব্য রাখছিলেন শিনজো আবে। দুপুরের ঠিক আগে সমাবেশে বক্তৃতার সময় ৪০ বছর বয়সী এক বন্দুকধারী শিনজো আবেকে লক্ষ্য করে পেছন থেকে গুলি চালান। প্রথম গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও নিরাপত্তা রক্ষীরা হামলাকারীকে ধরে ফেলার আগে দ্বিতীয় গুলিতে বিদ্ধ হন জাপানের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

>> আরও পড়ুন: কেন শিনজো আবের ওপর হামলা?

আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয় শিনজো আবেকে। কয়েক ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে পরপারে পাড়ি জমান দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা।

• ডাউনিং স্ট্রিটের মিউজিক্যাল চেয়ার

এক বছরেরও কম সময়ে তিনজন প্রধানমন্ত্রীকে পেয়েছে ব্রিটেন।

লকডাউনের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে মদের পার্টি কেলেঙ্কারি, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রচণ্ড চাপের মুখে গত জুলাইয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। নিজ দল কনজারভেটিভ পার্টির মন্ত্রী ও আইনপ্রণেতাদের একের পর এক পদত্যাগের পর দেশটির সরকারে কার্যত নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া জনসনের পদত্যাগ ছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না।

লকডাউনের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে মদের পার্টি কেলেঙ্কারি, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রচণ্ড চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বরিস জনসন

তিন বছরের টালমাটাল ক্ষমতার পর পদত্যাগে বাধ্য হওয়া প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের স্থলাভিষিক্ত হন লিজ ট্রাস। শুল্ক হ্রাসের পরিকল্পনা ঘিরে তৈরি হওয়া অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় পদত্যাগ করেন তিনিও। ব্রিটেনের রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ট্রাস।

গত ২৫ অক্টোবর কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ঋষি সুনাককে যুক্তরাজ্যের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত করেন রাজা তৃতীয় চার্লস। আর এর মধ্য দিয়ে গত ২০০ বছরের ইতিহাসে ব্রিটেনের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই রাজনীতিক।

• টালমাটাল দক্ষিণ এশিয়া

সংসদে বিরোধীদের অনাস্থা ভো‌টে হে‌রে গত ১১ এপ্রিল পা‌কিস্তা‌নের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ইমরান খান।

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর গত সাত দশকে প্রথমবারের মতো ভয়াবহ বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছে শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার পাশাপাশি তীব্র খাদ্য ও জ্বালানি সংকট ঘিরে ব্যাপক অস্থিরতার জেরে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বাসভবনে হামলা চালায় দেশটির হাজার হাজার বিক্ষোভকারী।

>> আরও পড়ুন: পাকিস্তানের কলঙ্ক: ৭৪ বছরে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রীরা

পরে দেশ ছেড়ে প্রথমে মালদ্বীপ পরে সেখান থেকে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে গিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন লঙ্কান এই প্রেসিডেন্ট। দেশটিতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে গেছে। ফলে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ অধ্যুষিত শ্রীলঙ্কা খাবার, ওষুধ, জ্বালানির মতো অতি জরুরি আমদানিও করতে পারছে না। তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার ঋণে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে শ্রীলঙ্কা।

• অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর আসনে আনোয়ার ইব্রাহিম

গত নভেম্বরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম। নির্বাচন-পরবর্তী দীর্ঘ অচলাবস্থার পর গত ২৪ নভেম্বর নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মালয়েশিয়ার প্রবীণ এই বিরোধী নেতাকে মনোনীত করা হয়।

প্রবীণ রাজনীতিক মাহাথির মোহাম্মদের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক আনোয়ারের প্রায় তিন দশকের ক্যারিয়ারের পাশাপাশি মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপটেও পরিবর্তন এনেছে।

এর আগে বারবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আনোয়ার ইব্রাহিম দূরে থেকেছেন। বছরের পর বছর ধরে উল্লেখযোগ্য দূরত্বে থাকা সত্ত্বেও নব্বইয়ের দশকে প্রথমে উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পরে ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দ্বারপ্রান্তে যান তিনি।

এর মাঝে সমকামিতা এবং দুর্নীতির অভিযোগে প্রায় এক দশক জেলে কাটিয়েছেন আনোয়ার। যদিও তার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অস্বীকার করেছেন তিনি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম ১৯৯০ এর দশকে তার পরামর্শক থেকে শত্রু বনে যাওয়া মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

প্রবীণ রাজনীতিক মাহাথির মোহাম্মদের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক আনোয়ারের প্রায় তিন দশকের ক্যারিয়ারের পাশাপাশি মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপটেও পরিবর্তন এনেছে।

মাহাথির এক সময় আনোয়ারকে ‘বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী’ বলে অভিহিত করেছিলেন এবং তাকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সমকামিতার অভিযোগ এবং দেশটির আর্থিক সংকট মোকাবিলা নিয়ে মতবিরোধের জেরে মাহাথির বলেছিলেন, আনোয়ার ‘তার চরিত্রের কারণে’ দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার অযোগ্য।

সমকামিতা এবং দুর্নীতির অভিযোগে প্রায় এক দশক জেলে কাটিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিম

দেশটির এই দুই রাজনীতিক যে জোটের মাধ্যমে সরকার গঠন করেছিলেন, ২০১৮ সালে সেই জোট ভেঙে দিয়ে মালয়েশিয়াকে নজিরবিহীন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝে ফেলে দেন। জোট থেকে আনোয়ার ইব্রাহিম বেরিয়ে যাওয়ায় ২২ মাসের জোট সরকারের অবসান ঘটে দেশটিতে।

জেলে এবং সংসদে থাকাকালীন বিরোধীদলীয় নেতা হিসাবে আনোয়ার ইব্রাহিম ধীরে ধীরে মালয়েশিয়ার দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনাল জোট থেকে সরে যান। ক্ষমতায় থাকাকালীন এই জোট দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়দের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছিল।

• বৈরী প্রকৃতি

বিপর্যয়কর বন্যা, ফসল-বিধ্বংসী খরা এবং রেকর্ড তাপপ্রবাহ আবারও এই গ্রহের জলবায়ু কত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, সেই কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ফসলের ক্ষতি করেছে রেকর্ড তাপপ্রবাহ। খরার কারণে আফ্রিকাজুড়ে লাখ লাখ মানুষ অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভয়াবহ বন্যা গ্রাস করেছে পাকিস্তানকে। কয়েক মাস আগের আকস্মিক বন্যায় দেশটির ৩ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ে দেশটিতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের।

আরও পড়ুন: পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যায় নিহত ৯৩৭

ফ্রান্সের পিয়েরে-সিমন ল্যাপ্লেস ইনস্টিটিউটের প্রধান জলবায়ু বিজ্ঞানী রবার্ট ভাটার্ড বলেছেন, ‘২০২২ সাল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছরগুলোর একটি। উচ্চ-তাপমাত্রার জন্য ইতিহাসের পাতায় রেকর্ড গড়েছে এই বছরটি। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এটি কেবল শুরু।’

পাকিস্তানে আকস্মিক বন্যায় ৩ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন

• বিদায় কোভিড-১৯

২০২২ সালে বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চল করোনাভাইরাস মহামারির ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে এসেছে। মাস্ক খুলে ফেলে, স্কুলে শিক্ষার্থীদের ফেরা আর ছুটিতে ভ্রমণ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে উদযাপনের পরিবেশে ফিরছে বিশ্ব।

তবে এই মুহূর্তে সবার মনোযোগ চীনের দিকে।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ‘জিরো-টলারেন্স’ নীতি মেনে চলার পর চীনে চলতি ডিসেম্বরে প্রায় সব ধরনের বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু হঠাৎ করে সব বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ায় করোনা সংক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটেছে দেশটিতে। গত কয়েক সপ্তাহে চীনে দৈনিক কোটি কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে দেশটির স্বাস্থ্য কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। অনেকেই চীনের করোনা মোকবিলার কৌশল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিধি-নিষেধ আকস্মিকভাবে প্রত্যাহারের মাধ্যমে চীন সম্ভবত করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে দ্রুত হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে করোনাভাইরাসে ১০ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে চীনে।

• আর কী ঘটেছে?

চলতি বছরের আরও কিছু ঘটনা আছে; যা সামনের বছর জটিল রূপ নিতে পারে। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর চীন এই দ্বীপ ভূখণ্ডের কাছে ব্যাপক রণসজ্জা শুরু করেছে।

কোরীয় উপদ্বীপের উপকূল থেকে সমুদ্রে এবং জাপানের আকাশসীমার দিকে প্রায় প্রতিদিনই রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে উত্তর কোরিয়া।

বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এই দেশটি ২০১৭ সালের পর বর্তমানে আরেকটি পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে সামরিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

ইরানে নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে মাহসা আমিনি নামের এক তরুণীর মৃত্যুর পর ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। প্রায় তিন মাস ধরে চলমান এই বিক্ষোভ দেশটির ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠীর জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। যা আগামী বছরেও গড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সূত্র: দ্য স্ট্রেইটস টাইমস, এএফপি, এপি, রয়টার্স, সিএনএন, বিবিসি।

এসএস