স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ ও তার অনুসারীরা, ছবি : বিবিসি

ভারতের হিন্দি ও অন্যান্য ভাষার সিনেমা, টিভি সিরিয়াল এবং ওটিটি প্ল্যাটফরমে হিন্দু ধর্মের প্রতি নিন্দা-বিদ্বেষ বা অবজ্ঞাসূচক কোনো বক্তব্য বা দৃশ্য আছে কিনা— সে সম্পর্কিত নজরদারি চালাতে ‘ধর্ম সেন্সর বোর্ড’ গঠন করেছেন ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধর্মগুরু স্বামী শঙ্করাচার্য অভিমুক্তেশ্বরানন্দ।

শুক্রবার রাজধানী নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দিয়ে স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় ভাবাবেগের ওপরে আঘাত দিতে পারে—এমন সিনেমা, সিরিয়াল, নাটক, বই পর্যবেক্ষণে রাখতে এই বেসরকারি সেন্সর বোর্ড তৈরি করছেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে এই ধর্মগুরু বলেন,‘যখন কোনও সিনেমায় কোনও ধর্মকে খাটো করে দেখাতে হয়, সেটা হিন্দু ধর্মকেই দেখানো হয়। আর অন্যান্য ধর্মকে ভালভাবে চিত্রায়িত করা হয়। বলিউড, টিভি সিরিয়াল, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম - সব জায়গাতেই হিন্দু ধর্মের দেবদেবীদের লাগাতার অপমান করে যাওয়া হচ্ছে। এটা আটকাতেই ধর্ম সেন্সর বোর্ড তৈরি করা হচ্ছে।’

নতুন এই সেন্সর বোর্ডে ১১ জন সদস্য থাকবেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ। এই সদস্যদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, ধর্মীয় গুরু, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ফিল্ম জগতের মানুষ—সবাই থাকবেন।

সিনেমার চরিত্র, স্ক্রিপ্ট, সংলাপ সবই থাকবে নজরদারিতে

শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দের বলেন, ‘সিনেমা, সিরিয়াল বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিতে ধর্মীয় চরিত্র, সংলাপ, রং, তিলক আর স্ক্রিপ্ট পরীক্ষা করে দেখা হবে। যদি কোনও জায়গায় দেখা যায় যে হিন্দু ধর্ম, বেদ- পুরাণের বর্ণনার অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে, তাহলে এই সেন্সর বোর্ড প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’

চলচ্চিত্র বা সিরিয়াল নির্মাতাদের কাছে ওই হিন্দু ধর্মগুরু আবেদন করেছেন যে তারা যেন কোনও ছবি বা সিরিয়াল তৈরি করার আগেই এই বোর্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে নেন, যাতে পরে আর কোনও সমস্যা না হয়।

বোর্ডটির পরামর্শদাতা হিসাবে রাখা হয়েছে বলিউডের চিত্র পরিচালক তরুণ রাঠিকে।

কেন এই 'ধর্ম সেন্সর বোর্ড'?

বিবিসিকে তরুণ রাঠি বলেন, ‘এই সেন্সর বোর্ড একদিক থেকে চলচ্চিত্র শিল্পকে সাহায্যই করবে। কেননা, কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে কেউ কোনও সিনেমা বানালেন, তারপরে দেখা গেল হিন্দু সমাজ সেটাকে বয়কট করছে। তখন তো প্রযোজকেরই ক্ষতি। সেই ক্ষতি এড়ানোর জন্যই বোর্ডের সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হচ্ছে।’

কিন্তু ভারতে তো একটা সরকার নিয়ন্ত্রিত ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড রয়েছে, যাদের ছাড়পত্র ছাড়া কোনও সিনেমা প্রদর্শনই বেআইনী। তাহলে নতুন করে ধর্মীয় বিষয়ে কেন একটা সেন্সর বোর্ড?

বিবিসির এই প্রশ্নের জবাবে  রাঠি বলেন, ‘ভারতীয় সংবিধানে এই অধিকার দেওয়া আছে যে এমন সংস্থা তৈরি করা যেতে পারে, যারা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিষয়গুলি পরিচালনা করবে। আর ধর্ম সেন্সর বোর্ডের মাধ্যমে আমরা ঠিক এটাই করতে চাইছি। আর সরকারী সেন্সর বোর্ড থাকা স্বত্ত্বেও তো এমন অনেক সিন বা সংলাপ ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে যেগুলো হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করে।’

‘এটা চলে আসছে কারণ আমরা চুপচাপ মেনে নিই। কিন্তু এখন আর চুপ করে থাকব না আমরা। সংবিধান যা অধিকার দিয়েছে, তার মধ্যে থেকেই আমাদের ধর্মের সঠিক চিত্রায়ণ হোক, এটাই আমরা চাই। এর জন্য প্রয়োজনে বিচারব্যবস্থারও শরণ নেব আমরা," বিবিসিকে বলেন মি. রাঠি।

নজরদারি চলবে আঞ্চলিক ভাষার ওপরেও

শুধু যে বলিউড সিনেমা বা হিন্দি সিরিয়ালের ওপরে নজরদারি চালাবে এই সেন্সর বোর্ড তা নয়। আঞ্চলিক ভাষাগুলিতে যেসব সিনেমা, সিরিয়াল, নাটক, বই এমন কি সামাজিক মাধ্যমে বা স্কুলের কোনও নাটকের ওপরেও নজর রাখবে এই 'সেন্সর বোর্ড।'

বিজেপির দক্ষিণ কলকাতা জেলা শাখার সভানেত্রী সঙ্ঘমিত্রা চৌধুরী নিজে একজন চিত্র নির্মাতা।

এই ধর্ম সেন্সর বোর্ড গঠনের কথা জেনে তার প্রতিক্রিয়া বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘একটা তো সরকারি সেন্সর বোর্ড আছে। তার বাইরে কোনও বেসরকারি সংস্থা কি এরকম সেন্সর বোর্ড তৈরি করতে পারে? আমারা জানা নেই। আর যে সরকারকে ভোট দিয়ে আমরা এনেছি, সেই বিজেপি সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অধীনেই তো সেন্সর বোর্ড। তারা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আছেন বিষয়গুলি সম্পর্কে? শঙ্করাচার্যজীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমার প্রশ্ন, বেসরকারিভাবে একটা সেন্সর বোর্ড গড়ার কি কোনও দরকার ছিল?’

তবে একই সঙ্গে সংঘমিত্রা বলছেন—সম্প্রতি অনেক প্রযোজক-পরিচালককেই দেখা যাচ্ছে ছবিতে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে এসে নিজেদের ফিল্মকে বিতর্কিত করে তুলছেন তারা, যার জেরে বিক্ষোভ হচ্ছে, বিরোধ হচ্ছে।

‘একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বাক স্বাধীনতা সবারই আছে। কারও বাক স্বাধীনতাকে এভাবে জোর করে আটকানো যায় না। কিন্তু একজন ফিল্ম ডিরেক্টর হিসাবে এবং একজন বিজেপি কর্মী হিসাবে বলব, কোনও ধর্মীয় ভাবাবেগকেই যেন আঘাত না করা হয় - শুধু হিন্দুদের নয়, মুসলমান, খ্রিস্টান বা যে কোনও ধর্মের আবেগকেই আঘাত করা উচিত নয়,’ বলছিলেন বিজেপি নেত্রী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সঙ্ঘমিত্রা চৌধুরী।

বলিউড কি হিন্দু বিরোধী?

ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধ নতুন নয়। শাহরুখ খান-দীপিকা পাডুকোন অভিনীত 'পাঠান' সিনেমার এক দৃশ্য নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্ক চলছে ভারতে।

ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠনের অভিযোগ, ওই ছবির একটি দৃশ্যে দীপিকা পাডুকোন গেরুয়া রঙের বিকিনি পরে গান করেছেন, যা হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হেনেছে। ওই ছবির বেশ কিছু দৃশ্য না বদলালে সেটিকে মুক্তি পেতে দেওয়া হবে না, এমন হুমকিও দেওয়া হয়েছে।

ভারতের সরকারি সেন্সর বোর্ড নির্দেশ দিয়েছে পাঠান সিনেমার কিছু দৃশ্য পরিবর্তন করতে নির্দেশ দেওয়ার পর সিনেমাটির ১০টি দৃশ্য কাঁটছাট করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম।

'পাঠান' এর আগে 'আদিপুরুষ' নামে একটি ফিল্ম নিয়েও হিন্দুত্ববাদীরা আপত্তি তুলেছিল।

তারও আগে 'কালী', 'পদ্মাবত', 'ব্রহ্মাস্ত্র', 'লক্ষ্মী'র মতো একাধিক সিনেমা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা কোথাও সিনেমা হলে গিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে, কোথাও ছবির নির্মানের সময়েই সেটে হামলা হয়েছে।

হিন্দু সাধু সন্তদের সর্বোচ্চ সংগঠন অখিল ভারতীয় সন্ত সমাজ তাদের এক সাম্প্রতিক বৈঠকে সরাসরিই বলেছিল যে বলিউড আসলে হিন্দু বিরোধী।

এসএমডব্লিউ