ছবি : বিবিসি

করোনা মহামারির সময় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ড বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (গার্মেন্ট) কারখানাগুলোকে প্রাপ্য মজুরির চেয়ে অনেক কম অর্থ দিয়েছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদিত পণ্য, অর্থাৎ পোশাকের প্রস্তুত ব্যয়ের চেয়েও তাদের দেওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল কম।

স্কটল্যান্ডভিত্তিক এবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এবারডিন বিজনেস স্কুল সম্প্রতি ২০০০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ১ হাজার গার্মেন্ট কারখানার তথ্য সংগ্রহ করেছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করে এসব কারখানা।

এবারডিন বিজনেস স্কুলের গবেষণা প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি হাতে পেয়েছে বিবিসি। সেখানে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির প্রথম দুই বছর আন্তর্জাতিক বাজারে সুতা,কাপড়, বোতামসহ প্রায় সব সরঞ্জামের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়; কিন্তু আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড তথা বায়াররা তাদের চুক্তির অর্থের পরিমাণ বাড়ায়নি। পূর্বে তারা যে পরিমাণ অর্থ দিতেন, মহামারির সময়ও তারা একই পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন।

যেসব আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড তাদের তৈরি পোশাকের জন্য বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল, তাদের ৯০ শতাংশই মহামারির প্রথম দুই বছর দেশের কারখানাগুলোকে প্রাপ্যের চেয়ে কম অর্থ পরিশোধ করেছে বলে উল্লেখ করেছে  এবারডিন বিজনেস স্কুল।

এসব কারখানার ৫ ভাগের একভাগের মালিক ও কর্মকর্তারা বিজনেস স্কুলের গবেষকদের জানিয়েছেন, বায়াররা যথাযথভাবে অর্থ না দেওয়ায় মহামারির প্রথম দুই বছর কর্মীদের বেতন দিতে তাদের ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তারা।

মজুরি কম দেওয়ার পাশাপাশি অর্ডার অনুযায়ী পোশাক প্রস্তুতের পর সেই অর্ডার বাতিল করা, চুক্তির অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়া-বিলম্বের দেওয়া বা মূল্যহ্রাস (ডিসকাউন্ট) দাবি করা, পোশাকের অর্ডার দিয়ে তার জন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম সময় বেঁধে দেওয়া— প্রভৃতি হয়রানিমূলক কাজও আন্তর্জাতিক বায়াররা মহামারির প্রথম দুই বছর নিয়মিতভাবেই করেছেন বলে উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনে।

আবেরডিন বিজনেস স্কুলের টেকসই হিসাববিজ্ঞান ও স্বচ্ছতা (সাসটেইনিবিলিটি অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি) বিভাগের অধ্যাপাক মুহম্মদ আজিজুল ইসলাম এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যে মজুরি প্রয়োজন— মহামারির প্রথম দুই বছর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার কর্মীরা সেই মজুরি পাননি। সেই সঙ্গে দেশটির প্রতি ৫টি কারখানার একটি কর্মীদের মজুরি দিতে গিয়ে রীতিমতো ভোগান্তির শিকার হয়েছে।’

‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাককর্মীদের প্রাপ্য বেতন থেকে বঞ্চিত করে নিজেদের মুনাফা বাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে যে মূল্যস্ফীতি শুরু হয়েছে, সেটিরও সুযোগ নেবে তারা। একদিকে খুচরা ক্রেতাদের কাছ থেকে দাম বেশি রাখবে, অন্যদিকে গার্মেন্ট মালিকদের প্রাপ্য অর্থ থেকে বঞ্চিত করবে। ফলে ভবিষ্যতে তাদের মুনাফার পরিমাণ আরও বাড়বে।’

ছোট ব্র্যান্ডগুলোর তুলনায় বড় ও অপেক্ষাকৃত ধনী ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে এই ঠকানোর প্রবণতা অনেক বেশি ছিল বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই দেশের ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই খাতের ওপর নির্ভরশীল।

অধ্যাপক আজিজুল ইসলামের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরে। বিবিসিকে তিনি জানান, গত ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশের গার্মেন্টকর্মীদের জীবন পর্যবেক্ষণ ও এ সম্পর্কিত গবেষণা করছেন তিনি।

‘বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে মহামারির আগে যতসংখ্যক শ্রমিক ছিল, (মহামারির) ২ বছর পর তার তুলনায় ৭৫ শতাংশ শ্রমিক কমে গেছে। আমার পর্যবেক্ষণ বলছে, মহামারির প্রথম দুই বছরে বাংলাদেশে চাকরি হারিয়েছেন অন্তত ৯ লাখ পোশাককর্মী।’

জাগরণের ডাক

এদিকে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক পেশাজীবী ট্রেড ইউনিয়নের নেতা ফিওনা গুচ এবারডিন বিজনেস স্কুলের এই গবেষণা প্রতিবেদনকে ‘জাগরণের ডাক’ বলে উল্লেখ করেছেন।

বিবিসিকে এই পেশাজীবী নেতা বলেন, ‘বায়ারদের মুনাফার জন্য পোশাকর্মীদের বঞ্চিত করার ব্যাপারটি মেনে নেওয়া যায় না; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য— আন্তর্জাতিক বায়াররা নিয়মিতই এ অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন।’

‘আমরা চাই, যুক্তরাজ্যের সরকার দেশের তৈরি পোশাকের বাজার পর্যবেক্ষণে একটি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা গঠন করুক। এই পদক্ষেপ না নিয়ে এই খাতের দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হবে না।’

এসএমডব্লিউ