ফাইল ছবি

সোনা হলো একটি হলুদ বর্ণের অন্যতম বিরল মূল্যবান ধাতু। যা আমাদের পৃথিবীতে পাওয়া যায়। বহু প্রাচীনকাল থেকে মানুষ এই ধাতুর সাথে পরিচিত। অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্য, চকচকে বর্ণ, বিনিময়ের সহজ মাধ্যম আর কাঠামোর স্থায়ীত্বের কারণে এটি অতি মূল্যবান ধাতু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। সোনা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের অলঙ্কার তৈরির প্রথা এখনও সমানভাবে বিরাজমান।

বিশ্বে সমস্ত ধাতুর মধ্যে সোনা সবচেয়ে বেশি নমনীয়। নমনীয়তা বলতে কোনও ধাতুর চ্যাপ্টা পাতে পরিণত হওয়ার যোগ্যতাকে বোঝায়। সোনা মানুষের আবিষ্কৃত প্রাচীনতম মৌল। এমনকি নব-প্রস্তর যুগেও সোনার তৈরি বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য ব্যবহৃত হতো। সে যুগের খননকৃত অনেক নিদর্শনে পাথরের জিনিসের সাথে এগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

আজকের এই প্রতিবেদনে সোনা আবিষ্কার, সোনা উত্তোলনের ইতিহাস, সোনা কেন মূল্যবান, সোনার দাম, সোনার দামের লাইভ আপডেট জানার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক...

সোনার হানাহানি কিংবা ভয়ের ইতিহাস

জার্মানির বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক কার্ল মার্ক্সও সোনাকে মানুষের আবিষ্কৃত প্রথম ধাতু হিসেবে চিহ্নিত করেন। অপরিবর্তনীয় রুপ, সহজ বণ্টনযোগ্যতা এবং চকচকে প্রকৃতির জন্য এটি অনেক আগে থেকেই অর্থের প্রধান মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সোনার সাথে পৃথিবীর অনেক বেদনা বিধুর ও ভয়ংকর কাহিনী জড়িত। সোনা অধিকারের লক্ষ্যে জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে অগণিত মানুষ।

আবার সোনার মালিক হয়েও কেউ শান্তি পায়নি। কারণ পাওয়ার পরই এসে যেতো সোনা হারানোর ভয়। যখন থেকে মানুষ সমাজবদ্ধ হতে শিখেছে এবং ধীরে ধীরে সামাজিক শ্রেণীবিভাগের সূচনা হয়েছে তখন থেকেই মানুষ খনি থেকে সোনা উত্তোলন করতে শুরু করে। তখন থেকেই অলঙ্কার তৈরীতে সোনা ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

প্রাচীনকালের সকল জাতিতেই স্বর্ণের ব্যবহার ছিল। মিসরীয় সম্রাটদের দ্বারা নির্মিত পিরামিড খনন করে প্রচুর সোনার অলঙ্কার ও জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। অনেককাল ধরেই মিসরীয়রা সোনা নিয়ে গবেষণা করেছে। চতুর্থ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত কিমিয়াবিদরা সোনা অনুসন্ধানের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পরশ পাথর অনুসন্ধান। তাদের বিশ্বাস মতে, পরশ পাথরের মাধ্যমে ক্ষার ধাতুকে সোনায় রুপান্তরিত করা সম্ভব।

এছাড়া চীন, ভারত এবং মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত রাজ্যগুলোতে খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীতেও সোনা ব্যবহৃত হতো। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতাব্দীতে গ্রীসে সোনার তৈরী টাকা প্রচলিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে আর্মেনিয়ায় সোনার টাকা ব্যবহৃত হতো। ভারত এবং নুরিয়া অঞ্চলে (উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা) প্রাচীনতম সোনার খনির সন্ধান পাওয়া যায়।

১৬০০ সালে রাশিয়ার খনি থেকে সোনা উত্তোলন শুরু হয়। তবে এর পরিমাণ খুব বেশি ছিল না। ১৯০০ সালের পর থেকে সেখানে সোনা উত্তোলনের পরিমাণ অনেকগুণ বেড়ে যায়।

সোনা কেন মূল্যবান?

প্রকৃতিতে দুষ্প্রাপ্যতার কারণে সোনাকে প্রাচীনকাল থেকেই অত্যন্ত দামি ধাতু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বেশ কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে, যদি সারাবিশ্বের সব সোনা একত্রিত করা হয়, তাহলে এর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন হতে পারে।

বিশ্বে আজও সোনার দুষ্প্রাপ্যতা বোঝার জন্য বিশেষ একটি দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। প্রতি বছর বিশ্বে সোনার সরবরাহ বৃদ্ধি পায় মাত্র ২ হাজার টন। আর এর বিপরীতে আমেরিকান স্টিলের সরবরাহ কেবল প্রতি ঘণ্টায় বৃদ্ধি পায় গড়ে ১০ হাজার ৫০০ টন।

গতিশীল বৈশিষ্ট্যের কারণে বিনিয়োগকারীরা সোনার ওপর আস্থা রাখেন এবং এর মূল্য নির্ধারণ করেন। কেউ সোনা দেখবেন, কেউ স্বল্পতার কথা ভাববেন, কেউ কেউ এর লেনদেনের ক্ষমতার কথা ভাববেন। আসলে সোনা এই বিশ্বের এক সম্পদের মূল্যের ভাণ্ডার। যে কারণে বিনিয়োগকারীদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে সোনা। প্রতিনিয়ত দামের ওঠানামায় মূল্যবান এই ধাতুতে বিনিয়োগ করেন তারা।

সোনার ঐতিহাসিক দাম

সোনার আসলে ঘটনাবহুল নানা ইতিহাস রয়েছে। ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে অর্থ হিসেবে প্রথম স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে আধুনিক কালে এসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকার সোনার মজুত শুরু করে। বিভিন্ন সময়ে সোনার দাম কেমন ছিল চলুন জেনে নেওয়া যাক...

•১৭৯২ সাল: যুক্তরাষ্ট্রে আইন করে শূন্য দশমিক ৫১৫৬ ট্রয় আউন্স সোনার বিনিময়ে ডলারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

• ১৮৩৭ : পুনরায় স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করা হয়। ওই সময় ডলারের দাম পুনর্মূল্যায়ন করা হয় এবং ২৫ দশমিক ৮ গ্রেইনে সোনার দর নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে এক ট্রয় আউন্স সোনার মূল্য ২০ দশমিক ৬৭ মার্কিন ডলার।

• ১৯৩৩ : মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট নির্বাহী আদেশ-৬১০২ এ স্বর্ণমুদ্রা, স্বর্ণের বার বা সোনার সনদের মালিকানাকে বেআইনি ঘোষণা করে স্বাক্ষর করেন।

• ১৯৩৪ : মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে মার্কিন কংগ্রেসে স্বর্ণ মজুত আইন পাস হয়। এই আইন পাসের পর ফেডারেলের হাতে থাকা সব সোনা মার্কিন ট্রেজারি বিভাগে স্থানান্তর করা হয়।

• ১৯৭০ : প্রতি ট্রয় আউন্স সোনা প্রায় ৪০ থেকে ৪২ মার্কিন ডলারে লেনদেন শুরু হয়।

• ১৯৮০: প্রতি ট্রয় আউন্স সোনার দাম নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। ওই বছর এক ট্রয় আউন্স সোনা ৮৩৭ মার্কিন ডলারে লেনদেন হয়।

বিনিয়োগকারীদের সোনা কেন পছন্দ?

নিজের সম্পদের ভাণ্ডারে বৈচিত্রতা, উচ্চ তারল্য, মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা এবং আরও অনেক কারণে মূল্যবান এই ধাতুর মালিকানায় নজর থাকে বিনিয়োগকারীদের। সোনায় বিনিয়োগ করার অর্থ হলো আপনি এমন একটি ধাতুতে বিনিয়োগ করছেন; যা বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয়। নিউইয়র্ক থেকে হংকং কিংবা জুরিখ পর্যন্ত বিশ্ববাজারে সোনার লেনদেন হয়।

বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশের সরকার অত্যাবশ্যক রিজার্ভ সম্পদ হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা মজুত রাখে। সোনা কেবল বিনিয়োগের জন্য শক্তিশালী এক পণ্যই নয় বরং বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এক ধাতু। তাই এই মূল্যবান ধাতুতে বিনিয়োগে ব্যবসায়ীদের আলাদা আকর্ষণ থাকে।

সোনার দামের ওঠানামা কেন?

অন্যান্য মূল্যবান সব ধাতুর মতো স্বর্ণের পণ্যসামগ্রী যেমন সোনার মুদ্রা এবং সোনার বারের দাম সারা দিন ওঠানামা করে। অর্থনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর নির্ভর করে সোনার দামেও ওঠানামা করতে পারে। ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যার সম্পর্ক সোনার দামে বিশেষ প্রভাব ফেলে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়ই ডলারের দাম কমে যাওয়ার সাথে সাথে সোনার মূল্য বেড়ে যায়। মূল্যবান এই ধাতু কিনতে তখন আরও বেশি ডলার খরচ করতে হয়।

বাংলাদেশে সোনার দর

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতিনিয়ত সোনার দাম ওঠানামা করে। বর্তমানে দেশের সোনার বাজার ইতিহাসের সোনালি অধ্যায় পার করছে। প্রায় প্রতিনিয়তই বাড়ছে সোনার দাম। 

২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝের দিকে (১৪ জানুয়ারি) সোনার দাম ভরিতে ২ হাজার ৬৮৩ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। এতে ভালোমানের প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৪২৯ টাকা। দেশের বাজারে এটিই সোনার সর্বোচ্চ দাম।

বাংলাদেশের বাজারে সোনার প্রত্যেক দিনের বাজার দর সম্পর্কে জানা যাবে এই ওয়েবসাইটে

এছাড়াও বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) ওয়েবসাইটেও সোনার হালনাগাদ দর সম্পর্কে জানা যাবে। সোনার দর জানতে ক্লিক করুন এখানে

প্রতিবেশি ভারতের বাজারে সোনার দামের লাইভ আপডেট জানতে এই লিঙ্কে প্রবেশ করুন

আর বিশ্ববাজারে প্রতি মুহূর্তে সোনার দর লাইভ জানতে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে

সূত্র: মনেক্স, উইকিপিডিয়া, গোল্ডপ্রাইস, গোল্ডেনচেন্নাই ডটকম।

এসএস