পোখারার পর্বত পরিষ্কার এবং দৃষ্টিসীমা ভালো ছিল। সেখানে হালকা বাতাস ছিল এবং আবহাওয়া নিয়ে কোনও ধরনের সমস্যা ছিল না

নেপালের পোখারায় পাহাড়ি গিরিখাতে বিধ্বস্ত হওয়া ফ্লাইটের পাইলট বিমানটি বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছালেও ‘অপ্রীতিকর কিছু’ রিপোর্ট করেননি। তবে তিনি শেষ মুহূর্তে এসে বিমানটির জন্য নির্ধারিত রানওয়ে পরিবর্তনের অনুরোধ জানিয়েছিলেন বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল কক্ষের কাছে। সোমবার পোখারা বিমানবন্দরের মুখপাত্র অনুপ জোশি এসব তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘পোখারার পর্বত পরিষ্কার এবং দৃষ্টিসীমা ভালো ছিল। সেখানে হালকা বাতাস ছিল এবং আবহাওয়া নিয়ে কোনও ধরনের সমস্যা ছিল না।’

রোববার দেশটির রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে পর্যটননগরী পোখারায় যাওয়ার পথে সেতী নদীর তীর ঘেঁষা পাহাড়ি এলাকায় ইয়েতি এয়ারলাইন্সের দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট এটিআর-৭২ ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত বিমানে ৬৮ জন আরোহী এবং চারজন কেবিন ক্রু ছিলেন। পোখারাগামী যাত্রীবাহী ওই বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ইতোমধ্যে ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করা হয়েছে।

বিধ্বস্ত এই বিমানের কোনও আরোহীই বেঁচে নেই বলে ধারণা করা হচ্ছে। মোবাইল ফোনে ধারণ করা স্থানীয়দের একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিমানটি বিমানবন্দরের কাছে আসার সাথে সাথে দ্রুতগতিতে উল্টে যায়। এরপর সেটি বিমানবন্দর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে সেতী নদীর তীরে পাহাড়ি গিরিখাতে আছড়ে পড়ে।

পোখারা বিমানবন্দরের মুখপাত্র বলেন, ‘পাইলট বিমানটির জন্য নির্ধারিত রানওয়ে ৩ পরিবর্তন করে রানওয়ে ১ এ অবতরণের অনুমতি চেয়েছিলেন। যা তাৎক্ষণিকভাবে বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে মঞ্জুর করা হয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘আমরা উভয় রানওয়ে পরিচালনা করতে পারতাম। বিমানটির অবতরণের জন্য দু’টি রানওয়েই পরিষ্কার করা হয়েছিল।’

জোশি বলেন, এটি ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক’ যে বিমানবন্দরটি চালু করার ১৫ দিনের মাথায় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। নেপালে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বিমান দুর্ঘটনা এটি। 

সোমবার সকালের দিকে দেশটির উদ্ধারকারীরা দুর্ঘটনাস্থল থেকে কাউকে জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। স্থানীয় কর্মকর্তা টেক বাহাদুর বলেছেন, জীবিত কাউকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে বিমানের ফ্লাইট ডাটা এবং ভয়েস রেকর্ডার পাওয়া গেছে। পোখারার টাকসি জেলার প্রধান কর্মকর্তা বাহাদুর বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত ৬৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছি। আরও চারজনের মৃতদেহ উদ্ধারে অভিযান চলছে।

এর আগে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল ওরফে প্রচন্ড বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে সোমবার একদিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন। এই দুর্ঘটনার কারণ জানতে সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা দিব্য ঢাকাল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, স্থানীয় সময় সকাল ১১টার টার কিছু পরে বিমানটিকে আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়তে দেখার পর দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যান তিনি।

তিনি বলেন, আমি পৌঁছানোর আগেই দুর্ঘটনাস্থলটি জনাকীর্ণ হয়ে যায়। বিমানের আগুন থেকে প্রচুর ধোঁয়া উড়ছিল। এর পরপরই সেটি মাটিতে আঘাত হানে।

দিব্য ঢাকাল বলেন, মানব বসতি কিংবা অন্য কোনও বাড়িতে বিমানটি যাতে আঘাত না করে সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন পাইলট। সেতী নদীর তীর ঘেঁষে একটি ছোট জায়গা ছিল এবং ফ্লাইটটি সেই জায়গায় মাটিতে আঘাত করে।

দূরবর্তী রানওয়ে আর আকস্মিক আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় নেপালে প্রায়ই বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। হিমালয়কন্যা খ্যাত নেপালে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর পর্বতমালার আবাসস্থল। আর বিমানবন্দরের পাশে বিপজ্জনক কিছু উঁচু-নিচু ঢালু পাহাড় রয়েছে। যে কারণে অনেক সময় বিমান উড্ডয়ন-অবতরণ করতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। 

তবে দেশটিতে অতীতের বেশ কিছু বিমান দুর্ঘটনার পেছনে নতুন করে এই খাতে বিনিয়োগের অভাব এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকেও দায়ী করা হয়। প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের মান নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হওয়ায় ২০১৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নেপালের সব এয়ারলাইন্সের বিমানকে ইইউর আকাশসীমায় নিষিদ্ধ করে।

২০১৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নেপালের সব এয়ারলাইন্সের বিমানকে ইইউর আকাশসীমায় নিষিদ্ধ করে

গত বছরের মে মাসে নেপালের উত্তরাঞ্চলে তারা এয়ারের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ২২ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। এই ঘটনার চার বছর আগে কাঠমান্ডুতে অবতরণের সময় অন্য একটি ফ্লাইটে আগুন লেগে ৫১ জন নিহত হন।

চিরঞ্জীবি পাউডেলের ভাই সাংবাদিক ত্রিভুবন ইয়েতি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন। চিরঞ্জীবি বলেন, নেপালে বিমান চলাচলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বৃদ্ধি করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। দুর্ঘটনার দায়ে এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলোকে শাস্তি দেওয়া উচিত। পাশাপাশি সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

তিনি বলেন, নবনির্মিত পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি নেমে এসেছিল বিমানটি। অবতরণের আগ মুহূর্তে সেটি বিধ্বস্ত হয়। মাত্র কয়েক দিন আগেই এই বিমানবন্দর চালু করা হয়েছিল। বিধ্বস্ত বিমানের আরোহীদের মধ্যে ৫৩ জন নেপালি, ৫ জন ভারতীয়, চারজন রুশ ও দু’জন কোরীয় নাগরিক ছিলেন। এছাড়াও আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্সের একজন করে নাগরিক ওই বিমানের যাত্রী ছিলেন।

খুম বাহাদুর ছেত্রী নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা রয়টার্সকে বলেছেন, বিমানটি যখন বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছায় তখন তিনি বাড়ির ছাদ থেকে সেটি দেখছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আমি বিমানটিকে কাঁপতে দেখেছি। একবার বামে তো পরক্ষণে ডানদিকে সরে যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ খাঁড়াভাবে পাহাড়ের গিরিখাতে আঁছড়ে পড়ে।’

সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স।

এসএস