পেশোয়ারের পুলিশ লাইন্স এলাকায় মসজিদের ভেতরে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে দুই ডজনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন

পাকিস্তানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়ার পেশোয়ার শহরের পুলিশ লাইন্স এলাকায় মসজিদের ভেতরে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে দুই ডজনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। সোমবার দুপুরে জোহরের নামাজ আদায়ের সময় এই বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন আরও দেড় শতাধিক মানুষ।

দেশটির নিরাপত্তা কর্মকর্তারা স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জিও নিউজকে বলেছেন, মসজিদে জোহরের নামাজের সময় সামনের সারিতে উপস্থিত ছিলেন আত্মঘাতী হামলাকারী। সেখানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।

বিস্ফোরণে হতাহতের তথ্য নিশ্চিত করে পেশোয়ারের পুলিশ কমিশনার রিয়াজ মেহসুদ ডন নিউজকে বলেছেন, মসজিদের ভেতরে উদ্ধার অভিযান চলমান আছে। অনেকেই মসজিদের ধ্বংস্তুপের নিচে আটকে পড়ায় হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দেশটির জ্যেষ্ঠ এই কর্মকর্তা বলেছেন, শহরের সব হাসপাতালে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করা হয়েছে। বিস্ফোরণে আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ আহতদের পেশোয়ারের লেডি রিডিং হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। তাদের রক্তদানে এগিয়ে আসতে সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

খাইবার পাখতুনখোয়ার তত্ত্বাবধায়ক মুখ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ আজম খান পেশোয়ারের সব হাসপাতালে চিকিৎসা জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন এই মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধারকারী সব সংস্থাকে ত্রাণ তৎপরতার গতি ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।

যা বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, বিস্ফোরণের সময় তিনি মসজিদে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, এটা শক্তিশালী বিস্ফোরণ ছিল। বিস্ফোরণের পর সর্বত্র ধোঁয়া উড়ছিল।

এই প্রত্যক্ষদর্শী আরও বলেন, মসজিদের ভেতরে ২০০ জনের বেশি মানুষ নামাজ আদায় করছিলেন। এটা আত্মঘাতী বিস্ফোরণ। কারণ বোমা হামলাকারী মসজিদের ভেতরে ছিলেন। নামাজ শুরু হওয়া মাত্রই বিস্ফোরণটি ঘটেছে। আহতদের মধ্যে বেশিরভাগই পুলিশ সদস্য বলে জানিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণের কারণে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন তিনি। পরে চেতনা ফেরার পর দেখেন, মসজিদের ছাদ ধসে গেছে।’

মসজিদটিতে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন সিভিল সেক্রেটারিয়েট অ্যাসোসিয়েশন পেশোয়ারের সভাপতি তাসাভুর ইকবাল। তিনি বলেন, পুলিশ লাইন্স এলাকায় সবসময় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরিচয়পত্র এবং দেহ তল্লাশি ছাড়া কেউই এই মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন না।

মসজিদের ভেতরে ২০০ জনের বেশি মানুষ নামাজ আদায়ের সময় বিস্ফোরণটি ঘটেছে

পেশোয়ারের এই বাসিন্দা বলেন, আজকের এই ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা অনেক বড় মসজিদ। একসাথে ৪০০ থেকে ৫০০ মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। বিস্ফোরণে মসজিদের একাংশ ধসে পড়েছে।

‘পুলিশের দুই চেকপোস্ট পেরিয়ে মসজিদে যান হামলাকারী’

দেশটির সাংবাদিক কাইসার বিস্ফোরণের ঘটনা বিশ্লেষণ করে বলেন, পুলিশ লাইন্স এলাকাটি পেশোয়ারের ক্যান্টের অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকায় অবস্থিত। এই এলাকায় ২৪ ঘণ্টাই আইনপ্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার ব্যাপকসংখ্যক সদস্য ও এফসি কর্মীরা উপস্থিত থাকেন।

তিনি বলেন, খাইবার পাখতুনখোয়ার কাউন্টার টেরোরিজম ডিপার্টমেন্ট (সিটিডি) ও পুলিশের তদন্ত বিভাগের কার্যালয় এখানে অবস্থিত। সাধারণত পুলিশের এই সদর দফতরে এক হাজার পুলিশ কর্মী উপস্থিত থাকেন।

পাকিস্তানি এই সাংবাদিক বলেন, ওই এলাকাটির ভেতরে যেতে হলে অন্তত দুটি পুলিশি তল্লাশিচৌকিতে থামতে হয়। অন্তত তিনবার তল্লাশি এড়িয়ে বোমা হামলাকারী ভেতরে ঢুকতে সক্ষম হয়েছেন।

তবে বোমাটি আগে থেকেই মসজিদে পেতে রাখা হয়েছিল নাকি এটি আত্মঘাতী হামলা— তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন দেশটির পুলিশ কর্মকর্তারা। বিস্ফোরণস্থলের আশপাশের সব সড়ক ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ইসলামাবাদেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

হামলার নিন্দা

এদিকে, মসজিদে বিস্ফোরণের এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, মসজিদের ভেতরে বিস্ফোরণ প্রমাণ করে, হামলায় জড়িতদের ‘ইসলামের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।’

মসজিদে হামলার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করে তিনি বলেছেন, ‘এই সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালনকারীদের লক্ষ্য করে ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে।’

দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা ইমরান খান এক টুইটবার্তায় এই ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসবাদী আত্মঘাতী হামলা’ উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছেন। হতাহতদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন তিনি।

‘সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলায় আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দাবাহিনীকে আরও উন্নততর প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন,’ টুইটবার্তায় বলেন ইমরান খান।

দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ জিও নিউজকে বলেছেন, বিস্ফোরণের তীব্রতায় মসজিদের ছাদ ধসে পড়েছে। যে কারণে হতাহতের সংখ্যা বেশি হয়েছে।

তিনি বলেন, এই হামলায় পুলিশকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। যে ব্যবস্থাপনায় আগে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করা হতো তা আবারও সচল করতে হবে। দেশটির এই প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, হুমকি পেলেও মানুষকে মসজিদে ঢুকতে বাধা দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কেউ এ ঘটনার দায় স্বীকার করেনি।

সূত্র: ডন, জিও নিউজ, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন।

এসএস