আপনি কি কখনও এই প্রশ্ন শুনেছেন যে কোন বয়সে একজন পুরুষের বাবা হওয়া উচিত? এমন প্রশ্ন খুব কমই শোনা যায়।

কিন্তু কোন বয়সে একজন নারীর মা হওয়া উচিৎ, এই প্রশ্ন আপনি নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সময়ে শুনেছেন। 

ভারতে সম্প্রতি এ প্রশ্ন নতুন করে আলোচনায় উঠেছে এবং এর কারণ আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার একটি বিবৃতি, যেখানে তিনি ২২ থেকে ৩০ বছর বয়সকে নারীদের মা হওয়ার সঠিক সময় হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, মা হওয়ার জন্য নারীদের সর্বোত্তম বয়স ২২ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। মহিলারা যদি এটি অনুসরণ করেন তবে এটি মা এবং শিশু উভয়ের জন্যই ভালো হবে। 

আসামে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর চেষ্টা করার জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন শর্মা। তিনি এই লক্ষ্যে তার সরকারের প্রচেষ্টা সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছিলেন। 

তার মতে, বাল্যবিবাহ এবং অল্প বয়সে গর্ভধারণ মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। 

তিনি বলেন, আমরা একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে জোর করে বিয়ে এবং তার অল্প বয়সে মাতৃত্বের কথা বলছি, তবে এটিও গুরুত্বপূর্ণ যে মেয়েদের বিয়ে করতে খুব বেশি সময় নেওয়া উচিৎ নয়। ঈশ্বর আমাদের শরীরকে বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন কাজ করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।
 
শর্মা আরও বলেন যে, ৩০ বছর বয়সী নারীদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে করা উচিৎ। 

তখন থেকেই একজন নারীর কোন বয়সে সন্তান নেওয়া উচিৎ সে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা চলছে ভারতে।

বিতর্কের শুরু
একটি পক্ষ বলে যে একজন নারীর তার শরীরের ওপর অধিকার রয়েছে এবং তার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমস্ত অধিকার রয়েছে, অর্থাৎ, তিনি কখন মা হতে চান তিনি সে সিদ্ধান্ত নেবেন।

নারীদের ইস্যুতে কাজ করা কর্মীরা হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বক্তব্যের সমালোচনা করছেন এবং বলেছেন যে কোনো ব্যক্তির, পদ নির্বিশেষে, কোনো নারীর কোন বয়সে মা হওয়া উচিৎ তা বলার অধিকার নেই।

চিকিৎসকদের কেউ কেউও মনে করেন, একজন নারীর মা হওয়ার উপযুক্ত বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এবং তারা এর জন্য চিকিৎসাগত ব্যাখ্যাও দেন।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শালিনী আগরওয়াল বলেন, একজন নারী যদি নির্দিষ্ট বয়সে মা হন, তাহলে তা তার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, কারণ একটি বয়সের পর নারীর শরীরে উর্বরতা কমে যায়।

তিনি বলেন, ৩০ বছর বয়সী নারীর শরীর উর্বর থাকে এবং তিনি গর্ভধারণ করতে সক্ষম হন, কিন্তু ৩০ বছর বয়সের পর নারীদের উর্বরতা কমতে শুরু করে এবং ৩৫ বছর বয়সের পর তাদের ডিম্বাণুর সংখ্যা কমে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের গুণগত মান কমে যায় এবং তা থেকে জন্ম নেওয়া শিশুর মধ্যে কোনো ধরনের ব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

এমন পরিস্থিতিতে যদি কোনো নারী মা হওয়ার কথা ভাবেন, তাহলে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যেই তার মা হওয়া উচিৎ। কারণ এর পরে বন্ধ্যাত্বের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

শালিনী আগরওয়াল আরও বলেছেন যে, ক্যারিয়ারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ, তবে মাতৃত্ব এবং ক্যারিয়ারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার।

মাতৃত্ব এবং ক্যারিয়ারের দ্বৈততা
ভারতের একজন নারী অধিকার কর্মী রঞ্জনা কুমারী বলেন, একজন চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারেন, কিন্তু একজন রাজনীতিবিদের এই বিষয়ে কথা বলা হাস্যকর। 

তিনি বলেন, আমরা আইটি, ব্যাংকিং এবং ট্রাভেল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে কর্মরত নারীদের নিয়ে গবেষণা করেছি। আমরা দেখেছি যে অনেক নারীকে বড় পদের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা এটি গ্রহণ করতে পারেনি, কারণ তাদের বদলি করা হচ্ছে বা তাদের পক্ষে বাড়ি এবং অফিসের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন ছিল। 

আরও পড়ুন : আসামে ১৫ দিনে ৪ হাজার বাল্যবিয়ে, একদিনে গ্রেপ্তার ১৮০০

তাই প্রশ্ন উঠেছে, পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা কি নারীদের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে? 

ভারতে সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব প্রধানত একজন নারীর ওপরেই থাকে। সমাজে এখনও এমন কোনো ধারণা তৈরি হয়নি যে যৌথ অভিভাবকত্ব বা যেখানে পিতামাতা উভয়ই সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 

রঞ্জনা কুমারী বলছেন, আজকাল দেখা যাচ্ছে কিছু নারী সন্তান নিতে চান না বা দেরিতে বিয়ে করতে চান।  

জলবায়ু পরিবর্তন, কর্পোরেট সেক্টর এবং উন্নয়নের মতো বিষয়গুলো নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে কভার করা সাংবাদিক অদিতি কাপুর বলেন, সন্তান ধারণ এবং ক্যারিয়ার গড়ার বোঝা একই সাথে একজন নারীর ওপর পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের জন্য এমন সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে, যা তাদের সহায়তা করতে পারে। 

স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সুচিত্রা দালভি বলেন, নারীদের চাকরির নিশ্চয়তা থাকতে হবে। বাড়ির পুরুষকেও পুরো দায়িত্ব নিতে হবে কারণ সে শুধু মায়ের সন্তান নয়, পিতৃত্বকালীন ছুটির সময় পার হয়ে গেলেও সন্তানের দায়িত্ব থেকে যায়।

অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ
ভারতের কর্মজীবী নারীরা তাদের প্রতিভা এবং দায়িত্ব দিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছেন এবং অর্থনীতিতে তাদের অংশগ্রহণও বাড়ছে। 

কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির (সিআইআই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ অনুসারে, ভারতে কর্মক্ষম বয়সের ৪৩.২ কোটি নারী রয়েছেন।  

ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইন্সটিটিউট অনুমান করেছে, নারীদের সমান সুযোগ দেওয়া হলে ২০২৫ সালের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৭৭০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেতে পারে। একই সঙ্গে জিডিপিতে তাদের অংশ ১৮ শতাংশ।

ডা. সুচিত্রা দালভি বলেন, হ্যাঁ এটা ঠিক যে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সে একটি মেয়ের শরীরে ভালো উর্বরতা থাকে এবং তার ভালো স্বাস্থ্য থাকে। আমরা যদি বিপি বা সুগারের ঝুঁকির কথা বলি, তাহলে ৪০ বছর বয়সের পর তা বেশি হয়। তবে একজন নারীকে তার দেহ ও জীবনের ওপর অধিকার দেওয়া উচিত।

এটা একটা সমাজিত বিড়ম্বনা যে একবিংশ শতাব্দীতেও একজন নারীকে শুধু মা, মেয়ে, স্ত্রী হিসেবে দেখা হয়, যারা দায়িত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে, কিন্তু তাদের জিজ্ঞেস করা হয় না তারা কী চায়- এমন মতও দিচ্ছেন অনেকে। 

এনএফ