ধ্বংসস্তূপের ভেতরে উষ্ণতার মধ্যে ছিলেন নেকলা ও তার ১০ দিন বয়সী ছেলে সন্তান

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার নিহতের ঘটনার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এতো হতাশার মাঝেও এসেছে ‘অলৌকিকভাবে’ জীবিত উদ্ধারের নানা গল্প। এটি এমনই এক গল্প।

গত ২৭ জানুয়ারি নেকলা কামুজ যখন তার দ্বিতীয় ছেলে সন্তানের জন্ম দেন, তখন তিনি তার নাম রাখেন ইয়াগিজ, যার অর্থ সাহসী।

ঠিক ১০ দিন পর স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭মিনিটে নেকলা তার ছেলেকে দক্ষিণ তুরস্কের হতায়ে প্রদেশে নিজ বাড়ির ভেতরে খাওয়াচ্ছিলেন। এর কিছুক্ষণ পর তারা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যান। নেকলা এবং তার পরিবার সামান্দাগ শহরে একটি আধুনিক পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন।

‘এটি বেশ সুন্দর একটি ভবন’, তিনি বলেন। সেখানে নিজেকে নিরাপদ মনে করতেন তিনি। সেই সকালে তিনি জানতেন না যে এলাকাটি ভূমিকম্পে ছিন্নভিন্ন, প্রতিটি মোড়ে মোড়ে থাকা ভবনগুলো লণ্ডভণ্ড এবং ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘যখন ভূমিকম্প শুরু হয়েছিল, আমি আমার স্বামীর কাছে যেতে চেয়েছিলাম যিনি অন্য ঘরে ছিলেন এবং তিনিও সেটাই চেয়েছিলেন।’

‘কিন্তু যখন তিনি আমাদের অন্য ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আমার কাছে আসার চেষ্টা করেছিলেন, তখন ওয়ারড্রবটি তাদের ওপর আছড়ে পড়ে। তখন তাদের পক্ষে নড়াচড়া করা অসম্ভব ছিল।’

১০ দিন বয়সী ছেলেকে নিয়ে এই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছিলেন নেকলা। পরে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে তাদের

‘ভূমিকম্প যখন ভয়াবহ রূপ নেয় তখন দেয়াল ভেঙে পড়ে। ঘরটি ভীষণ কাঁপছিল এবং ভবনটি জায়গা থেকে সরে যাচ্ছিল। যখন কম্পন থামে, আমি বুঝতে পারিনি যে আমি এক তলা নিচে পড়ে গিয়েছি। আমি তাদের নাম বলে চিৎকার করেছিলাম। কিন্তু কোনও উত্তর পাইনি,’ বলেন তিনি। ৩৩ বছর বয়সী এই নারী তার বাচ্চা বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করেন। তার পাশে পড়ে থাকা ওয়ারড্রবটির কারণে কংক্রিটের একটি বড় স্ল্যাবে পিষ্ট হতে হতে তারা বেঁচে যান।

প্রায় চারদিন তারা দু’জন এই অবস্থায় ছিলেন।

• প্রথম দিন

ধ্বংসস্তূপের নিচে ঘরের পোশাক পরা অবস্থায় আটকে ছিলেন নেকলা। ঘুটঘুটে কালো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাননি তিনি। তাই চারপাশে কী ঘটছে তা বোঝার জন্য তার অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল।

নিজের স্বস্তির জন্য, তিনি একটি কথাই আওড়াতেন যে ইয়াগিজ এখনও শ্বাস নিচ্ছে। ধুলোর কারণে, প্রথমে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সব স্থির হয়ে পড়ে। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে উষ্ণতার মধ্যে ছিলেন তিনি।

তিনি অনুভব করেছিলেন তার শরীরের নিচে বাচ্চাদের খেলনা চাপা পড়েছে কিন্তু নিজেকে তুলে সেটা বের করে স্বস্তি পাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে তিনি ছিলেন না।

ওয়ারড্রব, তার নবজাতক ছেলের কোমল ত্বক এবং তারা যে জামাকাপড় পরেছিলেন সেসব আর তিনি কংক্রিট ও ধ্বংসাবশেষ ছাড়া অন্য কিছুই অনুভব করতে পারছিলেন না। দূর থেকে তিনি কণ্ঠস্বর শুনতে পান। সাহায্যের জন্য তিনি চিৎকার করার চেষ্টা করছিলেন এবং ওয়ারড্রবে ঠুং ঠুং শব্দ করছিলেন।

‘কেউ কি আছেন? কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন?’ তিনি ডাকছিলেন।

ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধারের পর শিশু ইয়াগিজ

যখন তাতে কোনও কাজ হয়নি, তখন তিনি তার পাশে পড়ে থাকা ধ্বংসস্তূপের ছোট ছোট টুকরোগুলো তুলে নিয়ে সেগুলো দিয়ে ওয়ারড্রব ধাক্কা দেয়ার জন্য ব্যবহার করেন। ভেবেছিলেন এতে আরও জোরে শব্দ হবে। তবে তিনি তার ওপরে পৃষ্ঠে আঘাত করতে ভয় পাচ্ছিলেন কারণ জোরে ধাক্কা দেয়ার কারণে যদি সেটিও তার ওপর ভেঙে পড়ে!

তারপরও কারও কোনও সাড়া পাননি। নেকলা বুঝতে পারলেন, কারও আসার সম্ভাবনা নেই।

‘আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি,’ তিনি বলেন।

• চাপা পড়া জীবন

ধ্বংসস্তূপের নিচে অন্ধকারে নেকলা সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার জীবনটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। ‘আপনি অনেক কিছু পরিকল্পনা করেন যখন আপনার একটি নতুন বাচ্চা হয় এবং তারপর... হঠাৎ আপনি ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যান,’ তিনি বলেন।

তবুও তিনি জানতেন যে তাকে ইয়াগিজের দেখাশোনা করতে হবে এবং ওইটুকু জায়গায় তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের জন্য কোনও পানি বা খাবার পাননি তিনি। হতাশায় তিনি নিজের বুকের দুধ পান করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। নেকলা মাথার ওপরে ড্রিলের গর্জন অনুভব করেন সেইসাথে শুনতে পান মানুষের পায়ের আওয়াজ এবং তাদের কণ্ঠস্বর। কিন্তু শব্দগুলো অনেক দূর থেকে আসছিল এবং অস্পষ্ট ছিল।

তিনি তার শক্তি সঞ্চয় করার সিদ্ধান্ত নেন এবং বাইরে থেকে আসা আওয়াজ কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত চুপ থাকেন। তিনি প্রতিনিয়ত তার পরিবারের কথা ভেবেছিলেন; তার বুকের শিশুটি এবং স্বামী ও আরেক পুত্র ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কোথাও হারিয়ে গিয়েছে।

ভূমিকম্পে অন্য প্রিয়জনরা কেমন আছেন তা নিয়েও তিনি চিন্তিত। নেকলা ভাবতে পারেননি যে তিনি ধংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন। কিন্তু ইয়াগিজের উপস্থিতি তাকে আশাবাদী থাকার শক্তি দেয়। তিনি বেশিরভাগ সময় ঘুমাতেন এবং যখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে জেগে উঠতেন, তখন তিনি স্থির না হওয়া পর্যন্ত নীরবে তাকে খাওয়াতেন।

ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়েছিলেন নেকলার স্বামী ও আরেক সন্তান। তারাও জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। 

• অতঃপর উদ্ধার

মাটির নিচে ৯০ ঘণ্টারও বেশি সময় পরে নেকলা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনতে পান। তিনি ভাবেন যে স্বপ্ন দেখছেন কিনা।

কুকুরের শব্দের সাথে মানুষের শব্দও তিনি শুনতে পান। ‘আপনি ঠিক আছেন? হ্যাঁ হলে একবার ধাক্কা দিন।’ ধ্বংসস্তূপের কাছে এসে এক ব্যক্তি এ কথা বলেন।

‘আপনি কোন অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন?’

উদ্ধারকারীরা খুব সাবধানে তার সন্ধানে ধ্বংসস্তূপ খনন করতে শুরু করেন। তিনি তখনও ইয়াগিজকে ধরেছিলেন। হঠাৎ তার চোখের ওপর টর্চের আলো জ্বলে উঠলে অন্ধকার কেটে যায়। ইস্তাম্বুল মিউনিসিপালিটির ফায়ার ডিপার্টমেন্টের উদ্ধারকারী দল যখন জিজ্ঞাসা করে ইয়াগিজের বয়স কত, নেকলা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। তিনি কেবল জানতেন যে ভূমিকম্পের সময় তার বয়স ছিল ১০ দিন।

ইয়াগিজকে উদ্ধারকারীদের কাছে হস্তান্তর করার পর নেকলাকে তখন একটি স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তার সামনে ছিল বিশাল জনতার ভিড়। তিনি কোনও মুখই চিনতে পারেননি।

তাকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি নিশ্চিত হন যে তার অন্য ছেলেকেও উদ্ধার করা হয়েছে।

• ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে

যখন তিনি হাসপাতালে পৌঁছান, নেকলাকে পরিবারের অন্য সদস্যরা অভ্যর্থনা জানান। তারা জানান, তার ছয় বছর ধরে বিবাহিত স্বামী ইরফান এবং তার তিন বছর বয়সী ছেলে ইগিট কেরিমকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

ধ্বংসস্তূপে মায়ের বুকের দুধ পান করে সুস্থ ছিল শিশু ইয়াগিজ। শরীরে কোনও গুরুতর জখমও হয়নি তার।

কিন্তু তাদের পায়ে ও পায়ের পাতায় গুরুতর জখম থাকায় কয়েক ঘণ্টা দূরে আদানা প্রদেশের একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, নেকলা এবং ইয়াগিজ কোনও গুরুতর শারীরিক আঘাত পাননি। হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার আগে তাদেরকে সেখানে ২৪ ঘণ্টা কেবল পর্যবেক্ষণের জন্য রাখা হয়েছিল। নেকলার ওই মুহূর্তে ফিরে যাওয়ার মতো কোনও জায়গা ছিল না। কিন্তু পরিবারের একজন সদস্য তাকে কাঠ এবং টারপলিন দিয়ে তৈরি একটি অস্থায়ী নীল তাঁবুতে নিয়ে যান।

সেখানে মোট ১৩ জন ছিলেন। সবাই তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে। তাঁবুতে থাকা প্রতিটি পরিবার একে অপরকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল, একটি ছোট চুলার ওপরে কফি বানানো হয়, দাবা খেলে এবং গল্প করে তারা সময় কাটাচ্ছিলেন।

নেকলা তার সাথে যা ঘটেছে তা মেনে নেওয়ার ‘চেষ্টা’ করছেন। তিনি বলেছেন, তার জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি ইয়াগিজের কাছে ঋণী। ‘আমি মনে করি যদি আমার শিশু এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী না হতো, তাহলে আমিও এতো শক্তি পেতাম না,’ তিনি ব্যাখ্যা করেন।

ছেলেকে নিয়ে তার একমাত্র স্বপ্ন হল যে সে আর কখনও যেন এমন কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয়। ‘আমি খুব খুশি যে সে নবজাতক শিশু এবং তার এসব কিছুই মনে রাখবে না,’ তিনি বলেন।

নেকলার নাম ডাকতেই তিনি মুচকি হেসে ফেলেন। হাসপাতালের বিছানা থেকে ইরফান এবং ইগিত কেরিম হাসি মুখে হাত দোলাচ্ছে।

‘হাই যোদ্ধা, কেমন আছো আমার ছেলে?’ ইরফান পর্দার আড়ালে তার সন্তানকে জিজ্ঞাসা করেন।

এসএস