মুক্তি পেতে অনশন
নাউরুতে শরণার্থী শিবিরে দুঃসহ জীবন, ২ বাংলাদেশির অভিনব প্রতিবাদ
যথাযথ চিকিৎসাসেবা ও মুক্তির দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে মোহাম্মদ কাইয়ুম। তার ঠোঁট সেলাই করা, ছবি : আলজাজিরা
এক দশক ধরে অস্ট্রেলিয়ার শরণার্থীশিবিরে বন্দি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ কাইয়ুম বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। প্রতিবাদের সর্বশেষ ধাপ হিসেবে অনশনে বসেছেন দুই বাংলাদেশি অভিবাসন প্রত্যাশী, সেই সঙ্গে নিজেদের ঠোঁটও সেলাই করেছেন তারা।
প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের ছোট একটি দ্বীপরাষ্ট্র নাউরু। আকাশপথে অস্ট্রেলিয়া থেকে নাউরুতে যেতে সময় লাগে ৫ ঘণ্টা। সাগরপথে অবৈধভাবে যেসব অভিবাসনপ্রত্যাশী অস্ট্রেলিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়েন, তাদের জন্য নাউরুতে একটি শরণার্থী বা বন্দিশিবির করেছে অস্ট্রেলিয়ার সরকার। গত এক দশক ধরে নাউরুর সেই বন্দিশিবিরে আছেন শফিকুল ও কাইয়ুম।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার। নাউরুর শরণার্থীশিবিরের গত দশ বছর ধরে যে ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন তারা— তার বিবরণ আলজাজিরাকে দিয়েছেন শফিকুলই।
ঠোঁট সেলাই করার কারণে তার পক্ষে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আলজাজিরার কাছে নিজেদের দুর্দশা তুলে ধরেন শফিকুল।
বিজ্ঞাপন
শফিকুল জানান, তিনি ও কাইয়ুমসহ প্রায় দেড়শ’ অভিবাসনপ্রত্যাশী বর্তমানে বন্দি আছেন নাউরুর এই শিবিরে। পার্শ্ববর্তী পাপুয়া নিউগিনি দ্বীপেও এ রকম একটি শরণার্থী শিবির রয়েছে। তবে সেই শিবিরে কতসংখ্যক বন্দি আছেন, তা এখনও জানা যায়নি।
তবে নাউরু ও পাপুয়া নিউগিনি— উভয় দ্বীপের শরণার্থীদের অস্ট্রেলীয় সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, তাদেরকে কখনও অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।
হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজে শফিকুল লেখেন, ‘আমরা আমরণ অনশন শুরু করেছি। আমরা আমাদের ঠোঁট সেলাই করেছি...তাই খাওয়াদাওয়া কিংবা কথা বলা— কোনোটাই এই মুহূর্তে সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। যতদিন পর্যন্ত আমরা স্বাধীনতা ও যথাযথ চিকিৎসাসেবা না পাবো, ততদিন পর্যন্ত আমাদের এই প্রতিবাদ চলবে।’
শফিকুল জানান, তিনি ও কাইয়ুম পৃথকভাবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে অস্ট্রেলিয়া এসেছিলেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পা রাখার আগেই দেশটির নৌবাহিনী হাতে গ্রেপ্তার হন তারা এবং নৌবাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে নাউরুর শরণার্থীশিবিরে পাঠিয়ে দেন।
কিন্তু নাউরুর পরিস্থিতি শরণার্থীদের জন্য ‘একেবারেই নিরাপদ নয়’ উল্লেখ করে শফিকুল বলেন, ‘নাউরুর বাসিন্দারা আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করে— যেন আমরা মানুষ নই, জন্তুজানোয়ার।’
‘তাছাড়া এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই নড়বড়ে। আমরা এখানে নিরাপদ নই, নাউরুর বাসিন্দারা শরণার্থীদের পছন্দ করে না। তারা আমাদের ঘৃণা করে।’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইতোমধ্যে নাউরুর শরণার্থীশিবিরকে ‘উন্মুক্ত কারাগার’হিসেবে বর্ণনা করেছে। আগেও সেখানে বন্দীদের নিপীড়ন ও অবহেলা করার তথ্য পাওয়া গেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, নাউরুর শরণার্থীশিবিরে আশ্রিত উদ্বাস্তুদের ওপর প্রায়ই হামলা হয় এবং তাদের দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এখানকার বন্দীদের মানসিক চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই।
এই শরণার্থী শিবিরে আটকে রাখা হয়েছে দুই শতাধিক শিশুকেও। তাদের মধ্যে মাত্র ৪ জনকে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আটক এই শরণার্থী শিশুদের মধ্যে নিজেদের শারীরিক ক্ষতিসাধন ও আত্মহত্যাসহ নানা বিপজ্জনক আচরণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার সরকার খুবই কঠোর। অবৈধভাবে যারা অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করে, তাদেরকে সাধারণত নাগরিকত্ব দেয়না দেশটির সরকার।
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার আটক শরণার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসন সংক্রান্ত একটি চুক্তি হয় ক্যানবেরা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে। এই প্রকল্পের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন শফিকুল। কিন্তু তারপর ইতোমধ্যে তিন বছর পেরিয়ে গেছে।
শফিকুল বা কাইয়ুম কেউই জানেন না, কবে এই শিবির থেকে মুক্তি পাবেন তারা। কাইয়ুম অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য আবেদন করেননি, কিন্তু তারা দ্রুত এই দ্বীপ ছাড়তে চান এবং অনির্দিষ্টকালের আটকাদেশ থেকে মুক্তি পেতে চান।
শফিকুল লেখেন, ‘আমাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। স্বাধীনতা প্রয়োজন। আমরা বিচার চাই। আমরা কোনো অপরাধ ছাড়াই ১০ বছর ঝুলে রয়েছি। আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে। আমরা আর নিতে পারছি না। দয়া করে আমাদের স্বাধীনতার জন্য সাহায্য করুন।’
নিষ্ঠুরতাকে বৈধতাদান
নাউরুর শরণার্থী সহায়তা ও পরিষেবা বিষয়ক সরকারি দপ্তর আরপিসি ১ ভবনের বাইরে শুয়ে আছেন মোহাম্মদ কাইয়ুম (বাঁয়ে) এবং মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম (ডানে), ছবি : আলজাজিরা
শফিকুল ও কাইয়ুম তাঁদের স্বাধীনতা ও অন্য শরণার্থীদের জন্য প্রতিবাদ করলেও অস্ট্রেলিয়া সরকার সম্প্রতি নতুন আইন করেছে, যাতে নাউরুতে বন্দী রাখার ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। এতে আশ্রয়প্রার্থীদের সে দেশে পাঠানোর আইনি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সাবেক উদ্বাস্তু ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বেহরুজ বুচানি অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির বিরুদ্ধে নাউরুতে শরণার্থী পাঠানোর বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। অস্ট্রেলিয়া সরকারের দাবি, মানব পাচার রোধে তারা দূরের একটি দ্বীপে শরণার্থীদের পাঠিয়ে দেয়। তবে বেহরুজ দাবি করেন, নিষ্ঠুরতাকে বৈধতা দিতে অস্ট্রেলিয়া কর্তৃপক্ষ এসব কথা বলে থাকে। তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার প্রধান দুই রাজনৈতিক দল লেবার পার্টি ও ডানপন্থী লিবারেল পার্টি ভোট পেতে কঠোর অভিবাসন নীতিমালার কথা বলে থাকে। ভোটারদের সামনে আশ্রয়প্রার্থীদের বিষয়ে ভীতিকর তথ্য তুলে ধরা হয়।
বেহরুজ বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার সরকার জাতীয় নিরাপত্তার আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখে। তবে, আমি বলতে পারি, নাউরুতে আটক এসব মানুষকে ছেড়ে দিলে কিছুই হবে না।’
নিউজিল্যান্ডে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পাওয়ার আগে বেহরুজ ছয় বছর মানুস দ্বীপে আটক ছিলেন। তিনি বলেন, আশ্রয় প্রার্থী ও উদ্বাস্তুদের আটকে রাখতে পারলে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যায়। এ বছরেই অস্ট্রেলিয়া সরকারের সঙ্গে কারাগার পরিচালনাকারী একটি বেসরকারি মার্কিন কোম্পানির ২৮ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়েছে। ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্রেইনিং করপোরেশন (এমটিসি) নামের প্রতিষ্ঠানটি নাউরুতে সেনা সরবরাহ ও বন্দীদের কল্যাণে কাজ করবে।
শফিকুল ও কাইয়ুমের বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তাঁরা বলছেন, সরকার নাউরুতে ‘আঞ্চলিক প্রক্রিয়াকরণে’ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দ্বীপে আটক ব্যক্তিদের মানসিক চিকিৎসাসহ সব ধরনের পরিষেবার সুবিধা রয়েছে। প্রয়োজনে চিকিৎসার স্বার্থে অস্ট্রেলিয়া বা তাইওয়ানে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চালু রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরও বলেন, ‘আঞ্চলিক প্রক্রিয়াকরণ’ সুবিধার আওতায় সমুদ্রপথে অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় আসা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ‘প্রক্রিয়াকরণ’ দেশের মাধ্যমে মূল্যায়ন করার সুযোগ দেওয়া হয়। তাদের যদি আন্তর্জাতিক সুরক্ষার প্রয়োজন পড়ে, তখন একটি টেকসই অভিবাসী পথ বের করতে সহায়তা করা হয়। তৃতীয় আরেকটি দেশে পুনর্বাসন করার ফলে অস্ট্রেলিয়া তাদের নীতিতে অটল থাকতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের আটকে রাখতে নাউরুকে ব্যবহার বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চলছে। চলতি মাসের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিন পার্টি সিনেটে একটি বিল উত্থাপন করে, যাতে নাউরু ও পাপুয়া নিউগিনির শরণার্থীদের দ্রুত অস্ট্রেলিয়ায় আনার কথা বলা হয়।
বিলে বলা হয়েছে, আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থীদের অস্ট্রেলিয়া সাময়িক আশ্রয় দেবে। এ ছাড়া তাদের চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার সুযোগ করে দেবে। এরপর তাদের তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসিত করা হবে।
তবে রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মী ও শরণার্থী আইনজীবী ইয়ান রিন্তুল বলেন, গ্রিন পার্টির উত্থাপিত বিল পাশের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না লেবার পার্টি এ বিলে সমর্থন দেবে। এর বদলে অস্ট্রেলিয়া শরণার্থীদের অন্য কোনো দেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। এর মধ্যে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা নিউজিল্যান্ডে পুনর্বাসনের পথ বেছে নিয়েছেন। তবে তাঁদের অপেক্ষা কেবল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তারা জানেন না, আর কত অপেক্ষা করতে হবে তাদের।
ইয়ান রিন্তুল বলেন, নাউরুতে বন্দী শরণার্থীদের মধ্যে যাঁদের তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসনের সুযোগ নেই, তাঁদের নিয়ে উদ্বেগ বেশি। এসব মানুষের দায়িত্ব অস্ট্রেলিয়ার। তাঁরা নাউরুতে অনির্দিষ্টকাল আটক
থাকতে পারেন না। তাঁদের অবশ্যই অস্ট্রেলিয়াতে স্থানান্তর করতে হবে এবং ২০১৩ সালে তাঁরা যে সুরক্ষা চেয়েছিলেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
শফিকুল লেখেন, ‘১০ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। যথেষ্ট হয়েছে। দয়া করে আমাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করুন। আমরা আর নিতে পারছি না।’
এসএমডব্লিউ