চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব এবং ইরানের মাঝে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঘোষণায় পাল্টে যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি

মধ্যপ্রাচ্যের চিরবৈরী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বরফ অবশেষে গলেছে। দুই দেশের মাঝে অর্ধ-যুগের বেশি সময় পর আবার কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে উভয় দেশ দূতাবাস চালু করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এশিয়ার সুপার পাওয়ারখ্যাত চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব এবং ইরানের মাঝে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঘোষণায় পাল্টে যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি।

মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি সংকটময় পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা যাক, যেখানে ইরান এবং সৌদি আরব প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে আছে; চুক্তির ফলে সেখানে কী ঘটতে পারে?

• ইয়েমেন

ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আন্দোলনের মুখে সানায় ক্ষমতা থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার বিতাড়িত হয় ২০১৫ সালে। পরে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা-সমর্থিত জোটের নেতৃত্বে ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ করে সৌদি আরব।

এই যুদ্ধ গত কয়েক বছর ধরে ইয়েমেনে অচলাবস্থা তৈরি করেছে। উত্তর ইয়েমেনের ডি-ফ্যাক্টো কর্তৃপক্ষ এবং সৌদির সাথে ইয়েমেনের সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলগুলো থেকে প্রায়ই সৌদি আরবে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালিয়ে আসছে হুথিরা। প্রতিনিয়ত নিজেদের শক্তির জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে হুথিরা।

গত বছর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির পর ওমানের সহায়তায় প্রত্যক্ষভাবে পুনরায় আলোচনা শুরু করে রিয়াদ ও হুথি গোষ্ঠী। তবে ওই বছরের অক্টোবরে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এখনও অনেকাংশে কার্যকর আছে।

রিয়াদ-তেহরানের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সৌদি এবং হুথিদের মধ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া সহজ হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। ইয়েমেন যুদ্ধও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে। এই যুদ্ধের জেরে সৌদি আরবে মার্কিন অস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

• সিরিয়া

সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়নের কারণে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ২০১১ সাল থেকে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে ইরান।

জাতিসংঘে সিরিয়ার পক্ষে অবস্থান ধরে রেখেছে চীনও। এছাড়াও দামেস্কের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে দেশটি।

প্রথম দিকে আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টাকারী বিদ্রোহীদের সহায়তার মাধ্যমে সিরিয়ায় তেহরানের অবস্থান দুর্বল করার চেষ্টা করেছে রিয়াদ। তবে ইরানের সমর্থন আসাদকে তার লড়াইয়ের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। অন্যদিকে, দেশটিতে সশস্ত্র ও রাজনৈতিক বিরোধিতা করায় সৌদির সমর্থন হ্রাস পেয়েছে।

আসাদের আরব বিচ্ছিন্নতার বরফ গলার সময় সৌদি এবং ইরানের মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলো। সৌদি আরব বলেছে, আলোচনার মাধ্যমে আরব লীগে ফিরতে পারে সিরিয়া।

সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরান-সৌদির চুক্তিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’ অভিহিত করে স্বাগত জানিয়েছে। দেশটি বলছে, ইরান-সৌদি চুক্তি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে। তবে বিদেশিদের ছত্রছায়ায় থাকা দেশটির বিরোধী দলগুলো এই চুক্তির বিষয়ে এখনও কোনও মন্তব্য করেনি।

আর সিরিয়ায় ইরানের অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা করছে সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাওয়া ইসরায়েল।

• লেবানন

গত কয়েক বছর ধরে লেবাননের রাজনীতি ইরানপন্থী শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন জোট ও সৌদিপন্থী জোটের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

রাষ্ট্রের ওপর হিজবুল্লাহর দখল রয়েছে অভিযোগে ২০১২ সালে সৌদি আরব এবং অন্যান্য উপসাগরীয় দেশ লেবানন থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়।

পরে রাষ্ট্রদূতরা ফিরলেও লেবানন তখন থেকে গভীর আর্থিক মন্দার কবলে রয়েছে। বর্তমানে দেশটি নজিরবিহীন এক রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে দেশটিতে কোনও রাষ্ট্রপতি নেই। বর্তমানে সীমিত ক্ষমতার এক মন্ত্রিসভা দেশ পরিচালনা করছে।

তেহরান এবং রিয়াদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ লেবাননের অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে পারে বলে নতুন করে আশা তৈরি করেছে। লেবাননের সংসদের স্পিকার নাবিহ বেরি বলেছেন, ইতিবাচক এসব সংবাদ লেবাননের রাজনীতিবিদদের ‘দ্রুত’ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্ররোচিত করতে পারে।

হিজবুল্লাহ বলেছে, ইরান-সৌদির চুক্তি একটি ইতিবাচক ঘটনা। তবে এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিষয়ে এখনও জানা যায়নি বলে সতর্ক করে দিয়েছে লেবাননের এই রাজনৈতিক দল। দলটি খ্রিস্টান রাজনীতিবিদ সুলেমান ফ্রাঙ্গিয়েহকে প্রেসিডেন্ট পদে সমর্থন দিয়েছিল। দু’টি সূত্র বলছে, হিজবুল্লাহর এই সমর্থনের বিরোধিতা করেছে সৌদি আরব।

• ইরাক

২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন হামলায় সাদ্দাম হুসেইন ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইরাকে রাজনৈতিক, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রভাব গভীর করেছে ইরান। যা সৌদি আরবের জন্য সতর্ক ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়।

২০১৯ সালে ইরাকের আকাশসীমা ব্যবহার করে সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় ড্রোন হামলা চালায় ইরান। দুই দশকেরও বেশি সময় পর ২০২০ সালে সৌদি-ইরাকের সীমান্ত ক্রসিং পুনরায় খুলে দেওয়া হয়। এর ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত হওয়ার আশা তৈরি হয়।

বাগদাদ দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সরাসরি আলোচনার আয়োজন করেছিল। কিন্তু গত বছর ইরাক রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হওয়ায় সেই আলোচনা থমকে যায়।

সৌদি-ইরান চুক্তিকে ‘পৃষ্ঠা উল্টানোর’ উপায় হিসাবে স্বাগত জানিয়েছে বাগদাদ। ইরাকিরা একটি সাধারণ আঞ্চলিক শক্তির আশা করছেন; যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আরব উপসাগরীয় এবং ইরানের ওপর নির্ভরশীলতার পরিবর্তে অস্থিতিশীলতা এড়িয়ে তাদের দেশকে পুনর্গঠনের সুযোগ দেবে।

• সামুদ্রিক নিরাপত্তা

উপসাগরীয় জলসীমায়ও ইরান এবং পশ্চিমের সংঘাত দেখা গেছে; যে জলপথে বিশ্বের বেশিরভাগ তেল পরিবহন হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে নিজ দেশকে প্রত্যাহার ও তেহরানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর ২০১৯ সালে উপসাগরীয় জলসীমায় বেশ কয়েকটি ট্যাঙ্কারে হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

উত্তেজনা প্রশমনে সেই সময় সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব সরাসরি ইরানের সাথে আলোচনায় বসতে শুরু করে।

বাহরাইনে ঘাঁটি করা মার্কিন পঞ্চম নৌবহর ইরান থেকে আসা সন্দেহজনক অস্ত্রের চালান আটক করে। এছাড়া গত কয়েক বছরে ইরান ও ইসরায়েল পরস্পরের জাহাজে হামলার অভিযোগ করেছে।

সূত্র: রয়টার্স।

এসএস