রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (ফাইল ছবি)

যুক্তরাষ্ট্র এখনও জার্মানিতে তার দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে বলে দাবি করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আত্মসমর্পণের কয়েক দশক পরও জার্মানি এখনও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

রাশিয়ার একটি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট পুতিন এই মন্তব্য করেন। বুধবার (১৫ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নর্থ সাগরে পাইপলাইনে বিস্ফোরণের বিষয়ে জার্মানির প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যায় দেশটি এখনও ‘দখলদারিত্বের’ অধীনে রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার দাবি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আত্মসমর্পণের কয়েক দশক পার হলেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না জার্মানি।

রাশিয়ান টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট পুতিন আরও বলেন, ইউরোপীয় নেতারা তাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার বোধ হারানোর জন্য কার্যত ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

মূলত ইউক্রেনে হামলার দায়ে রাশিয়ার ওপর গত এক বছর ধরে নানা নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে। সেইসঙ্গে চাপের মুখে পশ্চিমা বিশ্ব দেশটি থেকে জ্বালানি আমদানি প্রায় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস কেনার বিষয়টি সবচেয়ে কঠিন ছিল।

‘নর্ড স্ট্রিম ১’ নামের এক পাইপলাইন রাশিয়া থেকে সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করে এসেছে। ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ প্রস্তুত হয়ে গেলেও যুদ্ধের কারণে সেটি আর চালু করা হয়নি। ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রহস্যজনকভাবে বাল্টিক সাগরের নিচে বিস্ফোরণের কারণে দু’টি পাইপলাইনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র এমন কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী বলে এতকাল বিভিন্ন মহলে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস দাবি করছে, সম্ভবত ইউক্রেনপন্থি একটি গোষ্ঠী দুই পাইপলাইনের ওপর সমন্বিত হামলা চালিয়েছে।

তবে ইউক্রেনের সরকার সেই ঘটনায় জড়িত, এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এর আগে ঘটনাস্থলের কাছের দুই দেশ সুইডেন ও ডেনমার্ক তদন্ত চালিয়ে ইচ্ছাকৃত বিস্ফোরণ সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও দুষ্কৃতিদের পরিচয় জানতে পারেনি।

রয়টার্স বলছে, জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলো গত বছর রাশিয়ার নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনে বিস্ফোরণের তদন্তের বিষয়ে সতর্কতার সাথে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো বলছে, পাইপলাইনে হামলা ইচ্ছাকৃতভাবে চালানো হয়েছিল। তবে এই হামলার জন্য কে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে তা বলতে অস্বীকার করেছে এসব দেশ।

রাশিয়ার একাধিক বার্তাসংস্থা জানিয়েছে, রশিয়া-১ টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ‘বিষয়টি হলো- ইউরোপীয় রাজনীতিবিদরা নিজেরাই প্রকাশ্যে বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানি কখনোই সম্পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘(দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে) সোভিয়েত ইউনিয়ন একপর্যায়ে জার্মানি থেকে নিজেদের বাহিনী প্রত্যাহার করে এবং দেশটিতে মস্কোর দখদারিত্বের অবসান ঘটায়। কিন্তু এটি সবাই জানে যে, আমেরিকানদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। তারা জার্মানিতে দখলদারিত্ব অব্যাহত রেখেছে।’

প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনে হওয়া বিস্ফোরণগুলো ‘রাষ্ট্রীয় স্তরে’ পরিচালিত হয়েছিল। স্বায়ত্তশাসিত একটি ইউক্রেনপন্থি গোষ্ঠী এই হামলার ঘটনায় দায়ী বলে অনেকে উল্লেখ করলেও সেই ধারণাকে ‘সম্পূর্ণ অর্থহীন’ বলে খারিজ করে দেন তিনি।

সম্প্রতি প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, দুষ্কৃতিদের এক দল একটি ছোট নৌকা করে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিশেষজ্ঞ ডুবুরি নামিয়ে বিস্ফোরণের প্রস্তুতি নিয়েছিল। সেই দলে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞও ছিলেন। তারা সম্ভবত ইউক্রেনীয় ও রুশ নাগরিক। ব্রিটিশ বা মার্কিন কোনও নাগরিক উপস্থিত ছিলেন না। তবে কে বা কারা সেই অভিযান আয়োজন ও তার অর্থায়ন করেছিল, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

জার্মান তদন্তকারীদের ধারণা, অর্থের বিনিময়ে মোট পাঁচ পুরুষ ও এক নারী সরাসরি সেই অভিযানে অংশ নিয়েছিল। তাদের সবার কাছে পেশাদারি কৌশলে জাল করা পাসপোর্ট ছিল। জার্মানির তিনটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত উদ্যোগে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, তারা জাল পরিচয় দেখিয়ে পোল্যান্ডের এক কোম্পানির কাছ থেকে একটি নৌকো ভাড়া করে।

জার্মানির উত্তরে রস্টক শহর থেকে তারা রওনা হয়ে ডেনমার্কের ক্রিস্টিয়ানসো দ্বীপে চলে যায়। পরিষ্কার না করেই নৌকাটি আবার ফেরত দেওয়া হয়। ফলে তদন্তকারীরা সহজেই কেবিনের টেবিলে বিস্ফোরকের চিহ্ন পেয়েছেন। মার্কিন ও জার্মান তদন্তে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও এখনও কোনও স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এমনও হতে পারে, দুষ্কৃতিরা তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করতে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু চিহ্ন রেখে দিয়েছিল। অর্থাৎ অন্তর্ঘাতের জন্য ইউক্রেনের সরকার বা নিরাপত্তা বাহিনীকে দায়ী করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি ইউক্রেন সত্যি সেই ঘটনায় জড়িত, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

টিএম