পাঞ্জাবের খালিস্তান সমর্থক নেতা অমৃতপাল সিংকে নিয়ে ভারতে তুলকালাম
ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তানি আন্দোলনের একজন নেতাকে আটক করার জন্য পাঞ্জাব-সহ সারা দেশে ব্যাপক অভিযান চালানো হলেও গত ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তিনি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
‘ওয়ারিস দা পাঞ্জাব’ গোষ্ঠীর প্রধান অমৃতপাল সিংয়ের খোঁজে পাঞ্জাব ছাড়াও হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশ-সহ আশপাশের রাজ্যগুলোতেও অভিযান চলছে। পাশাপাশি গোটা এলাকাতেই মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা ও এমন কী এসএমএস সার্ভিস পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
৩০ বছর বয়সী অমৃতপাল সিং শিখদের জন্য একটি পৃথক মাতৃভূমির দাবিতে খালিস্তানি আন্দোলনের একজন কড়া সমর্থক।
তার গাড়িবহরকে পুলিশ গত শনিবার বিকেলে জলন্ধরের কাছে শাহকোটে আটকে দিয়েছিল। কিন্তু একপাশে গ্রামের সরু রাস্তা দিয়ে তিনি গা ঢাকা দেন। এখনও পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। ইতোমধ্যে ওই শিখ নেতার শতাধিক অনুগামীকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যার মধ্যে অমৃতপাল সিংয়ের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ও আর্থিক মদতদাতা দলজিৎ সিং কালসিও রয়েছেন।
ওই খালিস্তানি নেতার চারজন ঘনিষ্ঠ সঙ্গীকে আটক করে এয়ারফোর্সের বিশেষ বিমানে দেশের অন্য প্রান্তে নিয়ে গিয়ে আসামের ডিব্রুগড়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মোড়া একটি কারাগারে রাখা হয়েছে। এই চারজনের বিরুদ্ধেই ভারতের অত্যন্ত কঠোর জাতীয় নিরাপত্তা আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে।
অমৃতপাল সিংয়ের বিরুদ্ধে এই অভিযানের প্রতিবাদ জানাতে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক বিভিন্ন খালিস্তানি সংগঠন লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে রোববার বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভকারীরা দূতাবাস ভবন থেকে ভারতের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকাও টেনে নামিয়ে ফেলেছেন।
— Ashok Swain (@ashoswai) March 19, 2023
এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে রোববার রাতে ভারতে নিযুক্ত সর্বোচ্চ ব্রিটিশ কূটনীতিককে তলব করা হয়েছে। লন্ডনের হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভারত জোরালো দাবিও জানিয়েছে।
• যেভাবে পালালেন অমৃতপাল
পৃথক খালিস্তানের সমর্থনে বিবৃতি দিয়ে সম্প্রতি প্রচারের আলোয় আসা অমৃতপাল সিং গত শনিবার পাঞ্জাবের বার্নালায় একটি ধর্মীয় সমাবশে যোগ দিতে অমৃতসরের কাছে জাল্লু খেরা গ্রামে তার বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিলেন।
সে দিন বিকেলের দিকে জলন্ধরের কাছে শাহকোটে তার বিরাট গাড়িবহরকে আটকায় পাঞ্জাব পুলিশ। বিশাল বাহিনী নিয়ে তারা অমৃতপাল সিংকে ধরার জন্যই সেখানে অপেক্ষা করছিল।
অমৃতপাল সিং নিজে ছিলেন একটি মার্সিডিজে। বিপদ আঁচ করে সেই মার্সিডিজটি ও কনভয়ের আরও দুটি ফোর্ড এনডিএভার ঝটিতি ইউ-টার্ন নিয়ে হাইওয়ে থেকে গ্রামের সরু রাস্তায় নেমে যায়।
পুলিশও সঙ্গে সঙ্গে তাদের তাড়া করে। প্রায় হিন্দি সিনেমার কায়দায় একটানা ১৫-১৬ কিলোমিটার ধরে চলে সেই রুদ্ধশ্বাস ‘কার চেজ’। অবেশেষে মেহাতপুর শহরের একটি ব্যস্ত বাজার এলাকায় এনডিএভার গাড়ি দুটি থেমে গেলে পুলিশ সেই গাড়ির আরোহীদের গ্রেপ্তার করে।
অমৃতপাল সিং যে মার্সিডিজে ছিলেন সেটি চালাচ্ছিলেন তার চাচা হরজিৎ সিং। কিন্তু পুলিশের গাড়ি যখন তাদের ধাওয়া করছে, তখনই একফাঁকে তিনি অমৃতপালকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেন। অমৃতপাল সিং আর একটি কালো রঙের ইসুজু গাড়িতে চেপে গা ঢাকা দেন। সেই গাড়িটি পরে মেহাতপুরের কাছে সালেমান গ্রামে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
রোববার রাতে অমৃতপালের চাচা হরজিৎ সিং ও তার নিজস্ব গাড়িচালক হরপ্রীত সিং মেহাতপুর থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশ আটক করে সেই মার্সিডিজ গাড়িটিও। কিন্তু অভিযান শুরুর পর পুরো দুদিন কেটে গেলেও অমৃতপাল সিং এখনও অধরাই রয়ে গেছেন।
• সরকার যা বলছে
ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভিযান নিয়ে এখনও মুখ না খুললেও দেশটির সংবাদমাধ্যম বলছে, পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টি সরকারের পুলিশ এবং কেন্দ্রের নিরাপত্তা বাহিনী একযোগেই এই অভিযান চালাচ্ছে।
তারা আরও বলছে, কয়েক দিন আগেই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগওয়ন্ত মানের সঙ্গে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত সিংয়ের একান্ত বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে দেশবিরোধী কার্যকলাপে অভিযুক্ত অমৃতপাল সিংকে গ্রেপ্তার করা হবে।
কিন্তু ঠিক তখনই যেহেতু দিল্লিতে ভারত জি-টোয়েন্টি জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক আয়োজন করছিল, তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে গ্রেপ্তারি অভিযান চালানো হবে সেই সব বৈঠক মিটে যাওয়ার পর।
তিন সপ্তাহ আগেই অমৃতপাল সিংয়ের শত শত সমর্থক তার এক ঘনিষ্ঠ সঙ্গীকে পুলিশি হেফাজত থেকে ছাড়িয়ে আনতে পাঞ্জাবের আজনালা থানায় তরবারি ও বন্দুক নিয়ে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল।
পুলিশের ওপর সেই সহিংস হামলার ভিডিও নিমেষে ভাইরাল হয় গোটা দেশে। তারও আগে থেকেই অমৃতপাল সিং অবশ্য কেন্দ্র ও পাঞ্জাবের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রাডারে ছিলেন। এখন তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি অভিযান শুরু হওয়ার পর ভারতের গোয়েন্দা সূত্রগুলো দাবি করছে, অমৃতপাল সিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের ঘনিষ্ঠ যোগসাজস আছে।
গত ৪৮ ঘণ্টার অভিযানে খালিস্তান সমর্থক ওই নেতার বিভিন্ন ডেরা থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে বলেও পুলিশ দাবি করছে। যেগুলো ‘আনন্দপুর খালসা ফ্রন্ট’ বা একেএফ নামে একটি সংগঠনের নামে জড়ো করা হচ্ছিল বলে তাদের বক্তব্য।
অমৃতপাল সিংয়ের ঘনিষ্ঠ অনুচরদের যেভাবে এয়ারফোর্সের বিমানে বিজেপি-শাসিত আসামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাতে এটাও স্পষ্ট যে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এখানে আম আদমি পার্টির (যারা পাঞ্জাবের শাসক দল) মতো বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েই কাজ করছে।
— Alex Ellis (@AlexWEllis) March 19, 2023
• তুলকালাম লন্ডনেও
এদিকে ভারতে যখন অমৃতপাল সিংকে আটক করতে অভিযান চলছে, তখন রোববার দুপুরের পর থেকেই ব্রিটেনের বিভিন্ন খালিস্তানপন্থী সংগঠন এর প্রতিবাদ জানাতে লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে সমবেত হয়।
পরে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, ‘খালিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানের মধ্যেই একজন বিক্ষোভকারী প্রায় বিনা বাধাতেই দূতাবাসের মূল প্রবেশপথে টাঙিয়ে রাখা জাতীয় পতাকার রড বেয়ে উঠে যান এবং তেরঙ্গা পতাকাটি টেনে নামিয়ে আনেন।
ভারত এই ঘটনায় যথারীতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছে– রোববার দিল্লিতে স্থানীয় সময় রাত সাড়ে দশটার দিকে তারা ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার ক্রিস্টিয়ানা স্কটকে ডেকে পাঠিয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
ডেপুটি হাইকমিশনারকে ডেকে পাঠানোর কারণ ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্স এলিস তখন দিল্লি থেকে দূরে ছিলেন।
সাধারণত কোনও বিদেশি রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হলে তার পরে সেটা জানানোই রীতি। কিন্তু এক্ষেত্রে নজিরবিহীনভাবে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী আগেভাগেই ঘোষণা করেন, দিল্লিতে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ যে কূটনীতিবিদ আছেন তাকে আমরা তলব করছি।
ক্রিস্টিয়ানা স্কট দিল্লির সাউথ ব্লকে পৌঁছানোর আগেই অবশ্য ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালেক্স এলিস টুইট করেন, লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাস প্রাঙ্গণে যে লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে আমি তার তীব্র নিন্দা করছি।
এই আচরণ ‘কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়’ বলেও তিনি ওই টুইটে মন্তব্য করেন। এরপর সোমবার সকালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী লর্ড তারেক আহমেদও বিবৃতি দেন। লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাসে এই হামলার ঘটনায় তিনি স্তম্ভিত এবং ব্রিটিশ সরকার দূতাবাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে বলে জানান তিনি।
এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে এই ঘটনার নিন্দার পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারের ‘নিষ্ক্রিয়তা’রও তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। দিল্লি জানিয়েছে, কেন ব্রিটেনের তরফে কোনও নিরাপত্তা ছিল না যাতে এই হামলাকারীরা দূতাবাস প্রাঙ্গণের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারল। সে ব্যাপারেও ব্রিটেনের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। বিবিসি বাংলা।
এসএস