পুরো পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশেই লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাপক দুুর্ভোগের মুখোমুখি হয়েছে লোকজন

তীব্র গরম আর ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন প্রতিবেশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের বাসিন্দারা। তারা বলছেন, প্রদেশের শহর থেকে গ্রাম— প্রায় সব এলাকায় ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। যে কারণে তীব্র গরমের পাশাপাশি লোডশেডিংয়ে নাজেহাল হয়ে পড়ছেন তারা।

পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেবল গরম নয়, মানুষের ভোগান্তির দোসর হয়েছে ঘন ঘন লোডশেডিং। আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কলকাতায় গরম থাকবে আরও কিছুদিন। তাপপ্রবাহের কষ্টও সহ্য করতে হবে লোকজনকে। ‘স্বস্তি’ দেওয়ার মতো বৃষ্টির কোনও লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই লাগাতার বিদ্যুৎবিভ্রাট। সব মিলিয়ে একেবারে নাজেহাল দশা শহরবাসীর।

আনন্দবাজার বলছে, গত কয়েক দিনের পরিস্থিতি যদি দেখা যায়, কলকাতাসহ শহরতলির যেসব এলাকায় কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই করপোরেশনের (সিইএসসি) পরিষেবা রয়েছে, সেখানে দুর্ভোগের শেষ নেই। বেলঘরিয়া থেকে বালিগঞ্জ, বহুতল ভবনের বাসিন্দা থেকে বস্তিবাসী সবাই লোডশেডিংয়ের দাপটে দুঃসহ অবস্থার অভিযোগ করছেন। যদিও এই পরিস্থিতিকে আদৌ ‘লোডশেডিং’ বলে মানতে রাজি নয় সিইএসসি কর্তৃপক্ষ।

তাদের দাবি, সিইএসসির কাছে বিদ্যুতের কোনও ঘাটতি নেই। চাহিদার পুরোটাই পূরণ করার ক্ষমতাও রয়েছে সংস্থাটির। সিইএসসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুতের এই সমস্যা ‘নিয়ম না মানা’ গ্রাহকদের জন্য তৈরি হয়েছে।

সব দোষ গ্রাহকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার যুক্তি হিসাবে সিইএসসি কর্মকর্তারা বলছেন, দিন দিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু অনেকেই বাড়িতে এসি নিলেও তা নিয়ম মেনে জানাচ্ছেন না। এর ফলে কোনও এলাকায় বিদ্যুতের যে পরিমাণ ‘লোড’ ঠিক করা রয়েছে, তার চেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। আর তাতেই এলাকায় বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

সিইএসসির নির্বাহী পরিচালক অভিজিৎ ঘোষ বলেন, ‘বিদ্যুতের কোনও ঘাটতি নেই। কিন্তু এত মানুষ আমাদের না জানিয়ে এসি লাগাচ্ছেন যে, সিইএসসির কাছে অনেক এলাকার লোড সম্পর্কে আগাম ধারণা নেই। সেই কারণেই সমস্যা হচ্ছে। আমরা সকলের কাছে আবেদন করছি, নিয়ম মেনে আমাদের জানিয়ে এসি লাগান ও ব্যবহার করুন।’

একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে ৪৫ হাজারের মতো এসি লাগানোর আবেদন জমা পড়েছে। আর এই সময়ে এসি বিক্রি হয়েছে দেড় লাখের বেশি।

সিইএসসির বক্তব্য, এটা ‘লোডশেডিং’ নয়, বরং ‘ফিউজিং’। অর্থাৎ যখনই নির্ধারিত লোডের বেশি ব্যবহার হয়ে যাবে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘ফিউজ ট্রিপ’ হয়ে যাবে। ফলে এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়। 

বাগুইআটির বাসিন্দা অভীক সমাদ্দার বলেন, ‘দিনের পর দিন একই জিনিস চলছে। রাত ১১-১২টা নাগাদ পাওয়ার কাট। আসছে ভোরের দিকে। সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে আসা ঘুমের প্রত্যাশী মানুষ দরদর করে ঘামবে। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আর যারা ইতোমধ্যে অসুস্থ, তারা আরও অসময়ের প্রহর গুণবেন। এই অনুভূতি আমার একার নয়। ফেসবুকে প্রত্যেক রাতে হাজার হাজার মানুষ এমন কথা লিখছেন।’

একই সুর গরফার এক অভিজাত আবাসনের বাসিন্দা শ্রীময়ী সান্যালের। তিনি বলেন, ‘পয়সা তো আমরা কম দিই না। যা বিল আসে তাই সময়ে মেটাতে হয়। কোনও যাচাই করার পদ্ধতিও নেই। তা সত্ত্বেও প্রতি দিন এমন কষ্ট কেন সইতে হবে? একে এত গরম, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লোডশেডিং মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। আমার সন্তানের বয়স মাত্র তিন বছর। প্রতিদিন রাতে তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।’

শুধু কলকাতা নয়, হাওড়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অনেক এলাকাতেও সিইএসসির পরিষেবা রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদের অভিযোগও একই রকম। আনন্দবাজারকে হাওড়া রামরাজাতলার বাসিন্দা অশীতিপর সৌরদীপ সামন্ত বলেন, ‘গরম যেভাবে বাড়ছে তাতে এসি তো চালাতেই হবে। আর পয়সা যখন নিচ্ছে তখন পরিষেবাও দিতে হবে। আমাদের দিকে আঙুল তুললেই তো আর হবে না।’

সিইএসসির নির্বাহী পরিচালক অভিজিৎ বলেন, ‘লোকজন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করায় ওভারলোডিং হচ্ছে। এর ফলে ফিউজিং ব্যবস্থা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ওভারলোডের ফলে বড় দুর্ঘটনা যাতে না হয় তার জন্যই এই ব্যবস্থা।’

কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা তো দিন দিন বাড়তেই থাকবে! আরও বেশি মানুষ এসি ব্যবহার করবেন। তা হলে এর কি কোনও সমাধান নেই? সিইএসসি কি বেশি লোড নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে না? আনন্দবাজারের এমন প্রশ্নের জবাবে অভিজিৎ বলেন, ‘কেউ যদি একটা বাল্ব বা ফ্যান লাগান তাতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু এসি লাগালেই ওভারলোডের সম্ভাবনা বেশি।’

বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে অভিযোগ জানালেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অনেক সময় লাগার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তিগত যে ব্যবস্থা রয়েছে তাতে লোড না কমা পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসবে না। সব ঠিক হওয়ার পরে ফের ওভারলোড হলে আবারও বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হবে। এটাই প্রযুক্তি।’

কলকাতায় চলতি বছরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বেড়েছে বলেও জানিয়েছে সিইএসসি। ২০২২ সালে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ সরবরাহ ছিল মে মাসের এক দিনে। সরবরাহ করা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর চলতি বছরে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় গত ১৮ এপ্রিল। চাহিদা বেড়েছে, তাই সরবরাহও বেড়েছে বলে দাবি করছে সিইএসসি।

আনন্দবাজার লিখেছে, শুধু সিইএসসি এলাকাতেই নয়, গোটা রাজ্যেই বিদ্যুৎবিভ্রাট সমস্যায় ফেলেছে মানুষকে। অভিযোগ রয়েছে রাজ্য বিদ্যুৎ পরিষদের বিরুদ্ধেও। সম্প্রতি রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, উপভোক্তারা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করার ফলেই বিভিন্ন জায়গায় সমস্যা হচ্ছে। এর জন্য কন্ট্রোল রুমও চালু করেছে বিদ্যুৎ দপ্তর।

এসএস