ওয়াগনার সৈন্যদের দ্রুতগতিতে অগ্রসর হওয়ার ঘটনায় প্রথম কয়েক ঘণ্টায় পুতিনকে পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণহীন এক নেতা মনে হয়েছিল

জুনের দীর্ঘ এক রাত আর এক দিনের জন্য রাশিয়ার কুখ্যাত ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন দৃশ্যত এক বিদ্রোহ ঘটালেন। রাজধানী মস্কোর দিকে নিজ বাহিনীর একটি বহরকে সাঁজোয়া যানসহ পাঠালেন। প্রশ্ন তুললেন, প্রেসিডেন্ট পুতিনের নীতি নিয়েও।

এমনকি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তার সাবেক এই মিত্রের বিরুদ্ধে ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ’ এবং ‘দেশের পিঠে ছুরিকাঘাত’ করার অভিযোগ তুলেছেন। তবে শনিবার শেষের দিকে প্রিগোজিন নাটকীয় বিদ্রোহের আচমকা অবসান ঘটান এবং নিজ বাহিনীর সৈন্যদের ঘাঁটিতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

তিনি ঘোষণা দেন, ‘আমরা গত ২৪ ঘণ্টায় মস্কোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছেছি। আমরা এই সময়ে আমাদের যোদ্ধাদের এক ফোঁটা রক্তও ঝরাতে দিইনি।’

২৪ ঘণ্টার এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সম্পর্কে এখনও অনেক কিছু রয়েছে অজানা...

• ওয়াগনার প্রধানের এই বিদ্রোহ কি পরিকল্পিত?

শনিবার মস্কো অভিমুখে সৈন্যদের এগিয়ে যাওয়ার এই ঘটনাকে ওয়াগনার প্রধান অভ্যুত্থান নয়, ‘ন্যায়ের জন্য যাত্রা’ বলে অভিহিত করেন। তবে তা যাই হোক না কেন, এর অবসান ঘটেছে অবিশ্বাস্য গতিতে।

রাতারাতি সীমান্ত পেরিয়ে রোস্তভ-অন-দনে পৌঁছে যায় প্রিগোজিনের বাহিনী। এই অঞ্চলের সামরিক সদর দপ্তর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি করেন তিনি

গত কয়েক মাস ধরে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। তার ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারে হাজার হাজার সদস্য নিয়োগ করেছেন, যাদের বেশিরভাগই রাশিয়ার কারাগারে বিভিন্ন অপরাধের দায়ে বন্দি ছিলেন।

>> আরও পড়ুন: ওয়াগনার বনাম রুশ সামরিক বাহিনী: কার সৈন্য কত?

দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সামরিক প্রধানদের সাথে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন তিনি। আগামী ১ জুলাইয়ের মধ্যে তার বাহিনীকে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর কমান্ড কাঠামোর আওতায় আনতে চাওয়ায় তার এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য বিদ্রোহে রূপ নেয়।

শনিবার ওয়াগনারের যোদ্ধারা অধিকৃত পূর্ব-ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রোস্তভ-অন-দনে ঢুকে পড়েন। তারপর মস্কোর পথে ভরোনেজ হয়ে মূল সড়কপথ ধরে অগ্রসর হতে থাকেন। এই ঘটনাকে ইউক্রেনে রাশিয়ার ১৬ মাসের পুরোমাত্রার যুদ্ধের মুহূর্তকে সংজ্ঞায়িত করছে বলে মনে করা হচ্ছিল।

অনেকেই বলছিলেন, যুদ্ধ এখন পুতিনের দরজায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু ওয়াগনারের সামরিক বহর মস্কোর উত্তরের দিকে পৌঁছানোর সাথে সাথে একটি চুক্তির খবর আসে। আর অনেকটা অদ্ভুতভাবে এই চুক্তিও হয় বেলারুশ নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায়।

এই গল্পকে খুব কম মানুষই যতটা সহজে বিশ্বাস করেন, বিষয়টা আসলে ততটা সহজ নয়। তারপরও চুক্তির পর ক্রেমলিনের অবস্থান যদি সঠিকই হয়, তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ায় প্রিগোজিনের ভূমিকার অবসান ঘটতে পারে।

ক্রেমলিন বলছে, চুক্তি অনুযায়ী ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন বেলারুশে যাচ্ছেন এবং তিনি কোনও ধরনের ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগের মুখোমুখি হবেন না। পাশাপাশি তার বাহিনীর যোদ্ধাদেরও সাধারণ ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বিদ্রোহ কি একেবারেই রক্তপাতহীন ছিল? এটি এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ অন্তত একটি সামরিক উড়োজাহাজ গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে।

শনিবার ওয়াগনারের যোদ্ধারা অধিকৃত পূর্ব-ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রোস্তভ-অন-দনে ঢুকে পড়েন

আর প্রেসিডেন্ট পুতিন এই বিদ্রোহের ঘটনাকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবেন, সেটা অন্য বিষয়।

• ওয়াগনার বনাম রুশ সামরিক প্রধানরা

রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ ওয়াগনারের সৈন্যদের জন্য যুদ্ধের পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কয়েক মাস ধরে তাদের ওপর ব্যাপক ক্ষুব্ধ ছিলেন প্রিগোজিন।

আবার ইউক্রেনে যুদ্ধরত ভাড়াটে এই বাহিনীকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনতে এক চুক্তিতে স্বাক্ষরের সময়সীমার প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন পুতিন। কিন্তু ওয়াগনার প্রধান রাশিয়ার সরকারি এই পদক্ষেপকে নিজের প্রভাবের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

গত শুক্রবার (২৩ জুন) দীর্ঘ এক বক্তৃতায় প্রিগোজিন রুশ নাগরিকদের উদ্দেশে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ পুরোটাই মিথ্যা আর ছলচাতুরীর ওপর চলছে। ‘বদমাশদের ছোট একটি দল’ নিজেদের প্রচারের জন্য জনসাধারণ ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রতারণা করছে।

>> আরও পড়ুন: এখন কী করবেন পুতিন?

এরপর রুশ প্রতিরক্ষা ও সামরিক প্রধানদের সঙ্গে প্রিগোজিনের বিবাদ চরম আকার ধারণ করে। প্রিগোজিন ইউক্রেনে তার সৈন্যদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালানোর দায়ে রুশ সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করেন। তবে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হামলার প্রমাণ হিসাবে তিনি একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন। যদিও তাতে কিছুই পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি।

শুক্রবার ভোরের দিকে তিনি মস্কো অভিমুখে সৈন্যদের ‘ন্যায়ের জন্য যাত্রা’ ঘোষণা করেন। ভিডিওতে চিৎকার করে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ২৫ হাজার সৈন্য আছেন। দেশে কেন এমন বিশৃঙ্খলা হচ্ছে, আমরা তা খুঁজে বের করতে যাচ্ছি। আমাদের সাথে যোগ দিন, যারা চান।’’ ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিন ওয়াগনার প্রধানকে পিছু হটতে এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।

 রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ওয়াগনারের ২৫ হাজার ভাড়াটে সৈন্যকে নিয়ন্ত্রণে আনার উপায় খুঁজছে

রাতারাতি সীমান্ত পেরিয়ে রোস্তভ-অন-দনে পৌঁছে যায় প্রিগোজিনের বাহিনী। এই অঞ্চলের সামরিক সদর দপ্তর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি করেন তিনি। রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের এই সদরদপ্তর থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। ভিডিওতে দেখা যায়, শহরের কেন্দ্রস্থলে ঢুকে পড়া ওয়াগনার সৈন্যরা কোনও ধরনের প্রতিরোধের মুখোমুখি হননি।

শনিবার সকালের দিকে তিনি ঘোষণা দেন, ‘আমরা (সামরিক) সদর দপ্তরের ভেতরে আছি।’ পরে তিনি বলেন, কোনও ধরনের গোলাগুলি ছাড়াই শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে। শহরটিতে তার সৈন্যরা একটি গুলিও ছোড়েননি।

এই ঘটনায় রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি প্রিগোজিনের নামে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। রোস্তভ থেকে ভরোনেজের পাশাপাশি পুরো মস্কো অঞ্চলে কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের আওতায় সতর্কতা জারি করা হয়।

• জাতির উদ্দেশে পুতিনের ভাষণ

শনিবার সকালের দিকে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া পাঁচ মিনিটের ভাষণে দেশের স্বার্থে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

জাতির উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা এক সুনিপুণ বিশ্বাসঘাতকার মুখোমুখি হয়েছি।’ পুরোনো সাবেক মিত্র ওয়াগনার প্রধানের নাম উল্লেখ না করে পুতিন বলেন, সামরিক বিদ্রোহের পেছনে যারা রয়েছেন, তারা রাশিয়ার সাথে প্রতারণা করেছেন। এ জন্য তাদেরকে জবাবদিহিতা করতে হবে।

এর পরপরই প্রিগোজিন দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্ট ‘গভীর ভুল’ করছেন বলে তার তীব্র সমালোচনা করেন। এর আগে পর্যন্ত তিনি কখনই সরাসরি পুতিনের প্রতি তার ক্ষোভ প্রকাশ করেননি।

কিন্তু সম্প্রতি ‘সুখী দাদা’ নিয়ে তার ব্যঙ্গাত্মক এক মন্তব্যকে পুতিনের পরোক্ষ সমালোচনা হিসাবে দেখা হয়েছিল। গত মাসে তিনি প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, যদি এটা প্রমাণিত হয় যে, এই দাদা পুরোপুরি নির্বোধ, তাহলে রাশিয়া কীভাবে জিতবে?

ওয়াগনারের সাঁজোয়া যানের বহরকে ভরোনেজ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে মোটরওয়ে ধরে আরও উত্তরে লিপেটস্কের দিকে যেতে দেখা যায়। ভরোনজে বিমান হামলায় একটি জ্বালানি শোধনাগার পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে কেন সেটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়।

২৪ ঘণ্টায় মস্কোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায় ওয়াগনার সৈন্যরা

• চ্যালেঞ্জের মুখে পুতিন?

ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করছেন না— এমন অবস্থানে অনড় প্রিগোজিন। তার মতে, ইউক্রেনে ওয়াগনার কেবল ভাড়াটে বাহিনী হিসাবে লড়ছে। এছাড়া তিনি প্রেসিডেন্টের নেতৃত্ব নিয়েও বিতর্ক করছেন না বলে জানিয়েছিলেন। যদিও সামরিক দাবি পূরণ না হলে তিনি মস্কোর দিকে যাওয়ার হুমকি দেন।

তবে ওয়াগনার সৈন্যদের দ্রুতগতিতে অগ্রসর হওয়ার ঘটনায় প্রথম কয়েক ঘণ্টায় পুতিনকে পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণহীন এক নেতা মনে হয়েছিল। তারপর শনিবার সন্ধ্যায় বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর পক্ষ থেকে একটি চুক্তির ঘোষণা আসে; যিনি পুতিনের আরেক ঘনিষ্ঠ মিত্র। পশ্চিমা গণমাধ্যমে বেলারুশের এই প্রেসিডেন্টকে ‘পুতিনের পুতুল’ হিসাবে প্রায়ই অভিহিত করা হয়।

চুক্তির শর্তে বলা হয়, প্রিগোজিন বেলারুশ চলে যাবেন এবং তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হবে না। পরে তাকে একটি গাড়িতে করে রোস্তভ ছেড়ে যেতে দেখা যায়। ওয়াগনার যোদ্ধারা বিচারের হাত থেকে রক্ষা পাবেন এবং যারা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে চান, তারা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী সেটা করতে পারবেন।

• আকস্মিক বিদ্রোহ কোথায় নিয়ে গেল পুতিনকে?

বিদ্রোহের মুখে পুতিনকে অত্যন্ত দুর্বল মনে হয়েছে। প্রিগোজিনের নেতৃত্বে যেখানে পুরো দিন ধরে বিশৃঙ্খলার রাজত্ব চলেছে। আর বিপদ থেকে বাঁচতে বেলারুশের নেতার ওপর পুতিনের ভরসা করাটাও দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে।

২০২০ সালের ব্যাপক কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর বিক্ষোভ অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল বেলারুশ। সেই সময় রাশিয়াই প্রধান ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হয়ে তাকে রক্ষা করেছিল। বিতর্কিত সেই নির্বাচনের পরও লুকাশেঙ্কোর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান রুশ প্রেসিডেন্ট।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় বলেছে, ওয়াগনার বিদ্রোহ ও বেলারুশের নেতার মধ্যস্থতায় চুক্তি পুতিনের জন্য লজ্জাজনক। তবে রুশ সমাজে আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গিও আছে, রাশিয়ার নাগরিকরা এখন প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিকল্প দেখেছেন এবং কয়েক ঘণ্টা ধরে দেশের পরিস্থিতিকে চরম নৈরাজ্যজনক মনে হয়েছে তাদের কাছে।

এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ওয়াগনারের ২৫ হাজার ভাড়াটে সৈন্যকে নিয়ন্ত্রণে আনার একটি উপায়ও খুঁজে পেয়েছে। এই খেলা এখনই থামছে না। তবে তাদের অশান্ত নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন আপাতত দৃশ্যপটের বাইরে।

সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স।

এসএস