সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর দুই মাসের মধ্যে গত শনিবার সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন দেখেছে মিয়ানমার। এতে শোকে স্তব্ধ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির সাধারণ মানুষ।

নারী ও শিশুসহ গত শনিবার দেশটির সামরিক বাহিনী ১১৪ জন বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে অনেককে বিক্ষোভরত অবস্থায় আবার অনেককে তাদের বাড়িতে হত্যা করা হয়। গণতন্ত্রের জন্য জীবন দেওয়া এসব বিক্ষোভকারীকে ‘ফলেন স্টার-স’ বা ‘খসে যাওয়া তারা’ বলে উল্লেখ করেছে অভ্যুত্থানবিরোধীরা।

শনিবার সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহতদের একজন ৪০ বছর বয়সী আয়ে কো। চার সন্তানের জনক আয়ে বসবাস করতেন দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে। সেখানকার বাসিন্দারা বলছেন, পেশায় আয়ে কো ছিলেন নারকেলের তৈরি স্ন্যাকস ও পানীয় বিক্রেতা। প্রতিবেশিদের তিনি খোঁজ-খবর রাখতেন।

বেশ কয়েকটি সূত্রের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, মান্দালয় শহরের ওই এলাকায় অভিযানের সময় সেনা সদস্যদের গুলিতে আহত হন আয়ে কো। এরপর তাকে জ্বলন্ত টায়ারের মধ্যে নিক্ষেপ করে সেনারা। সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভের অংশ হিসেবে সেদিন রাস্তায় টায়ারগুলো জ্বালিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা।

বার্মিজ গণমাধ্যম মিয়ানমার নাউ’কে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘সেনাসদস্যরা আগুনে নিক্ষেপ করার পর আয়ে কো সাহায্য চেয়ে চিৎকার করছিলেন।’

কিন্তু তিনি সাহায্য পাননি। প্রথমে গুলি করে এবং পরে আগুনে পুড়িয়ে তাকে হত্যা করা হয়। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী রোববার স্বজনরা তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এসময় আয়ে কো’র মৃত্যুকে ‘বিশাল ক্ষতি’ বলে উল্লেখ করে তার এক আত্মীয়।

বার্তাসংস্থা এএফপি’কে ওই আত্মীয় বলেন, ‘পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে তিনিই (আয়ে কো) কেবল রোজগার করতেন, খাবার জোগাড় করতেন।’

করোনা মহামারির সময়ে হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছিলেন অং জিন ফিয়ো 

মান্দালয় শহরের অন্য স্থানে অং জিন ফিয়ো নামে ১৮ বছর বয়সী এক তরুণের মৃত্যুতে শোক পালন করছে মানুষ। বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, স্থানীয় লিন লাত ফুটসাল ক্লাবের গোলরক্ষক ছিলেন অং জিন। এছাড়া করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করার পর স্থানীয় একটি হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) কাজে সাহায্য করতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।

পরিবারের সদস্যরা সাংবাদিকদের জানান, শনিবার নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়ার আগে অভ্যুত্থানবিরোথী বিক্ষোভের সামনের সারিতে ছিলেন অং জিন।

ছেলের কফিনের পাশে বসে কাঁদছিলেন অং জিনের মা। তিনি বলেন, ‘আমার এই একটাই মাত্র ছেলে... আমাকেও মরে যেতে দাও, যেন আমি আমার ছেলের সঙ্গে থাকতে পারি।’

নিহতদের মধ্যে কয়েকজন শিশুও রয়েছে। ১১ বছর বয়সী আয়ে মাত থু’র মরদেহের কফিনের পাশেই রয়েছে খেলনা, ফুল এবং হেলো কিটি’র আঁকা ছবি। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনকারীদের দমনের সময় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মাওলামাইন শহরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

দেশের মধ্যাঞ্চলীয় মেইকতিলা শহরে নিজের বাড়ির মধ্যেই ১৪ বছর বয়সী প্যান এয়ি ফিয়ু’কে গুলি করে হত্যা করে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। প্যানের মা বিবিসি বার্মিজ’কে বলেন, বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা আসছেন শুনে তিনি দ্রুত ঘরের সব দরজা বন্ধ করে দিতে থাকেন। কিন্তু তারপরও নিজের শিশু সন্তানকে বাঁচাতে ব্যর্থ হন তিনি।

তিনি বলেন, ‘হঠাৎই আমি তাকে (প্যান এয়ি ফিয়ু) মাটিতে পড়ে যেতে দেখি। প্রথমে ভেবেছিলাম- সে হয়তো পা পিছলে পড়ে গেছে। কিন্তু পরে তার বুক থেকে রক্ত বের হয়ে আসতে দেখি।’

বিবিসি জানিয়েছে, দেশের বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনে নিজের বাড়ির বাইরে খেলা করার সময় শনিবার ১৩ বছর বয়সী সাই ওয়াই ইয়ানকে গুলি করে হত্যা করে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। রোববার তার মৃতদেহের কফিনের পাশে বিমর্ষ হয়ে বসে ছিলেন পরিবারের সদস্যরা।

‘তোকে ছাড়া আামি কিভাবে বেঁচে থাকবো’, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন ওয়াই ইয়ানের মা।

সামরিক বাহিনীর আক্রমণের মুখে শনিবার ইয়াঙ্গুনে অন্যান্য বিক্ষোভকারীর সঙ্গে নিজেকেও রক্ষার চেষ্টা করছিলেন ১৯ বছর বয়সী তি সান ওয়ান ফি। একপর্যায়ে গালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। প্রতিবেশিদের বরাত দিয়ে রয়টার্স বলছে, ওয়ান ফি’র মুখে সবসময় লম্বা হাসি লেগে থাকতো।

তবে ছেলের বন্ধুদের কাঁদতে নিষেধ করেছেন ওয়ান ফি’র বাবা মা। তারা বলছেন, তাদের ছেলে শহীদ হয়েছেন।

এদিকে রোববার পৃথক দুই স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে আরও দুই বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানিয়েছে রয়টার্স। মিয়ানমার নাউ’র প্রতিবেদন অনুযায়ী- রাজধানী নেইপিদোতে একদল বিক্ষোভকারীকে লক্ষ্য করে সেনারা গুলিবর্ষণ করলে একজন নিহত হন।

তবে রোববার ইয়াঙ্গুনে বা মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে বড় আকারের বিক্ষোভের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। শনিবার এই দুই শহরে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। এতো কিছুর পরও এখনও বেপরোয়া মিয়ানমারের জান্তা সরকার। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে- দেশটির সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার শেষ কোথায়?

সূত্র: বিবিসি

টিএম