টানা প্রায় একসপ্তাহের চেষ্টার পর অবশেষে সরানো সম্ভব হয়েছে সুয়েজ খালে আটকে পড়া জাহাজ এভার গিভেন। সোমবার এক ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, জাহাজটির পশ্চাৎভাগ খালের তীরের দিকে ঘুরে গেছে, ফলে খালের অনেকটা জায়গা অবমুক্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সমুদ্রসেবা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইঞ্চিকেপও এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আটকে পড়া জাহাজটি সরানো হয়েছে।

গত ২২ মার্চ লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে যাওয়ার পথে সুয়েজ খালে আটকা পড়েছিল পানামার পতাকাধারী জাহাজ এভার গিভেন। প্রবল বাতাস ও ধূলিঝড়ের কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘুরে গিয়ে সুয়েজ খালের দক্ষিণাংশের সংকীর্ণ একক লেনে আড়াআড়িভাবে আটকে গিয়েছিল দুই লাখ বিশ হাজার টনের এই বিশাল জাহাজটি, যার ফলে প্রায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্ব বাণিজ্যের পরিবহন ব্যবস্থায়।

শনিবার মিশরের সুয়েজ শহরে এক সংবাদ সম্মেলনে খাল কর্তৃপক্ষের প্রধান ওসামা রাবিই জানিয়েছিলেন, অচলাবস্থা কাটাতে কাজ চলছে। কিন্তু এখনও নিশ্চিত নয় যে, কখন জাহাজটি আবারও পানিতে ভাসতে পারবে।

সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘জাহাজের পশ্চাৎদেশ সুয়েজের দিকে ঘুরতে শুরু করেছে। (স্থানীয় সময়) রাত ১১টা পর্যন্ত এটাই ইতিবাচক দিক; কিন্তু তীব্র স্রোতের কারণে আমরা কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি।’

সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, স্রোতের কারণে কাজ বন্ধ থাকায় রোববার সকাল থেকে জাহাজে থাকা কন্টেইনারগুলো সরাতে শুরু করেন তারা। এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার কন্টেইনার তারা সরিয়েছেন।

বিবিসিকে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এমনিতেই জাহাজটি যথেষ্ট ভারী। তারওপর বিপুল পরিমাণ কন্টেইনার থাকার কারণে এটির ওজন আরো বেড়ে গিয়েছিল।’

‘একদিকে তীব্র স্রোত, অন্যদিকে জাহাজটির অতিরিক্ত ওজনের কারণে সেটি উদ্ধারে বারবার সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল আমাদের। এ কারণে রোববার সকাল থেকে কন্টেইনারগুলো জাহাজ থেকে নামানো শুরু হয়। জাহাজটির ওজন কমে যাওয়ার ফলেই এটি সরানো সম্ভব হয়েছে।’

ওই কর্মকর্তা জানান, আটকে পড়া জাহাজটি মুক্ত করতে এর আগে ১৪টি উদ্ধারকারী নৌকা (টাগবোট) ব্যবহার করা হয়েছিল; কিন্তু তাতে কাজ হয় নি। তারপর এ কাজের জন্য একটি বিশেষ ক্রেন ব্যবহার করেছে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ; যেটি ২০০ ফুট উচ্চতা থেকে কন্টেইনার ওঠাতে ও নামাতে সক্ষম।

গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সুয়েজ খাল বন্ধ থাকায় এর প্রবেশমুখ পোর্ট সুয়েজ এবং ভূমধ্যসাগরের পোর্ট সাইদে আটকা পড়েছে সাড়ে তিনশরও বেশি জাহাজ। ফলে ওই সমুদ্রপথে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের জাহাজজট। গত ছয় দিন ধরে বহু মালবাহী জাহাজকে তাদের মূল রুট থেকে সরিয়ে বিকল্প পথে আফ্রিকা ঘুরে গন্তব্যের দিকে যাত্রা করতে হয়েছে।

মিসরের সুয়েজ অঞ্চলে ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে যুক্ত করে প্রায় ১৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালটি খনন করা হয়। ১৮৫৬ সালে গঠিত হয় সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানি। প্রায় তিন বছর পর, ১৮৫৯ সালের এপ্রিল মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় খালটির খননকাজ।

১০ বছর পর ১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর নৌ-চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় সুয়েজ খাল। এই খালের আয় দিয়েই পূরণ হয় মিসরের জাতীয় বাজেটের প্রায় ৮০ শতাংশ।

সুয়েজ খাল খনন করার আগ পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জাহাজগুলোকে ভূমধ্যসাগর থেকে পুরো আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে, উত্তমাশা অন্তরীপ পাড়ি দিয়ে আরব সাগর হয়ে ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগরে যেতে হতো। এই যাত্রা ছিল সময়সাপেক্ষ ও বিপজ্জনক। তবে সুয়েজ খাল খনন ও চালুর পর এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যকার সেই দূরত্ব বহুগুনে কমে এসেছে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ১২ শতাংশ পরিচালিত হয় এই খাল দিয়ে। বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, সমুদ্রে দৈনিক হিসেবে চলাচলকারী জাহাজের ৩০ শতাংশই যাতায়াতের জন্য সুয়েজ খাল ব্যবহার করে। সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বছরজুড়ে প্রায় ১৯ হাজার জাহাজ চলাচল করেছে এই খাল দিয়ে। দৈনিক হিসেবে যা প্রায় ৫২টি।

সূত্র: বিবিসি

এসএমডব্লিউ