আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে একচেটিয়া আধিপত্য নিয়ে অবস্থান করছে ডলার। ডলারের মতো না হলেও একচ্ছত্র অবস্থায় না থাকলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ইউরো এবং জাপানের মুদ্রা ইয়েনও বৈশ্বিক বিনিময় মাধ্যম হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।

এবার এই তালিকায় স্থান করে নিতে চায় ভারতের মুদ্রা রুপিও। নিজেদের মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক বিনিময় মাধ্যমে উন্নীত করতে ভারতের সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানা গেছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) নির্দেশনার বরাত দিয়ে শুক্রবার এ তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।

রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার নির্বাহী পরিচালক রাধাশ্যাম রাথো স্বাক্ষরিত সেই নির্দেশনায় দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বৈদেশিক বাণিজ্যে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ডলারের পরিবর্তে রুপির ব্যবহার বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাইরের দেশের বিভিন্ন ভারতীয় কোম্পানি ও ব্যবসায়ীগোষ্ঠী ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যেসব লেনদেন করেন— সেখানেও ধীরে ধীরে ডলারের পরিবর্তে রুপির ব্যবহার বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে রুপিভিত্তিক বন্ড ‘মাসালা’ ছাড়ার ব্যাপারটিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায়। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মতে, আগামী ২ থেকে ৫ বছরের মধ্যে এই বন্ডের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ানোর পাশাপাশি সেখান থেকে আয় হিসেবে প্রাপ্ত কর নিয়মিত পর্যালোচনার সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সেই সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে রুপিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) স্পেশাল ড্রইং রাইটস (এসডিআর) তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাংক। রুপি যদি এসডিআর তালিকায় স্থান করে নিতে পারে, সেক্ষেত্রে ডলার, পাউন্ড, ইউরো, ইয়েনের পাশাপাশি ভারতীয় এই মুদ্রাকেও বিভিন্ন দেশকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারবে আইএমএফ।

যে কারণে রুপিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা করতে চায় ভারত

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ডলার এবং রুবল— উভয়েরই ব্যবহার হতো। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ডলারের গুরুত্ব বাড়তে থাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে। বর্তমান সময়ে সেই গুরুত্ব এত উচ্চপর্যায়ে পৌঁছেছে যে অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক অর্থব্যবসস্থার বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, ডলারের কারণে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যে একদিকে ‘মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা’ ভোগ করছে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশ।

সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির পর এই ব্যাপারটি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। কারণ, এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস সরবরাহ থমকে যায়, ফলে বিশ্বজুড়ে হু হু করে বাড়তে থাকে জ্বালানির দাম।

জ্বালানিপণ্যের বৈশ্বিক বাজার পুরোপুরি ডলারভিত্তিক হওয়ার কারণে তখন উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো প্রথম দিকে নিজেদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ভেঙে জ্বালানি তেল কেনা শুরু করেছিল, কিন্তু এতে ডলারের মজুত কমে যাওয়া শঙ্কা দেখা দিলে অধিকাংশ দেশ জ্বালানি পণ্য কেনা কমিয়ে দেয়। ফলে একদিকে তেলের বাজারে মন্দাভাব দেখা দেয়, অন্যদিকে লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে ডলারের দাম।

ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশ ব্যাপক মন্দার ঝুঁকিতে রয়েছে। অর্থানৈতিক ভারসাম্য টালমাটাল হওয়ার কারণে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম।

অনেক রাজনীতি বিশ্লেকদের মতে, ডলারের একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও একচ্ছত্র সুবিধা ভোগ করছে যুক্তরাষ্ট্র, যা অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক রাজনীতির ভারসাম্যকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

পাউন্ড, ইউরো, ইয়েন যদিও ডলারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তবে এসব মুদ্রার ব্যবহারের ব্যাপ্তি এখনও ডলারের চেয়ে অনেক কম। ফলে ডলারের আধিপত্য কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না।

তবে রুপি যদি আন্তর্জাতিক মুদ্রায় উন্নীত হয় এবং আইএমএফের এসডিআর তালিকায় অন্তর্ভুক্তির যোগ্যতা অর্জন করে, সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির জন্য তা সুবিধাজনক হবে। কারণ ১৪০ কোটি মানুষ অধ্যুষিত ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের আয়তনই অনেক বড়। তার ওপর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বহু দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে দেশটির। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ-আফ্রিকার অনেক দেশের ভারতীয় ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তারা দিন দিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রভাবশালী হয়ে উঠছেন। তাদের সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে ভারতের অর্থনীতির।

তাই বৈদেশিক লেনদেনে রুপির ব্যাবহার বাড়লে তা একদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির জন্য সুবিধাজনক হবে, তেমনি লাভবান হবেন প্রবাসী ভারতীয় ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারাও।

এসএমডব্লিউ