চীন এবং ইরান গত সপ্তাহে একটি চুক্তিতে সই করেছে। দেশ দু’টির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বলছেন, এই চুক্তিটির মাধ্যমে আগামী ২৫ বছর দু’দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বজায় থাকবে। চুক্তির বিস্তারিত এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইরানের তেল কেনার পাশাপাশি তেহরানে কিছু বিনিয়োগও করবে চীন। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানে বিদেশী বিনিয়োগ অনেকটা বন্ধ রয়েছে।

চীনের সুবিস্তৃত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ কর্মসূচিতে সর্বশেষ সংযোজন এটি। বিশ্ব শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে এমন সব যোগাযোগ বাড়াতে হবে বেইজিংকে। গত বছর এই সহযোগিতা চুক্তির খসড়া ফাঁস হওয়ার পর অনেক ইরানি নাগরিক চীনের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।

বেল্ট অ্যান্ড রোডসের চুক্তিগুলো সাধারণত চীনের স্বার্থই রক্ষা করে থাকে। এর মধ্যে কিছু প্রাথমিকভাবে আকর্ষণীয় মনে হলেও শেষ পর্যন্ত ছোট ও গরীব দেশগুলোর জন্য সেগুলো গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে; যখন তারা দেখেছে— চুক্তির উদ্দেশ্য থেকে ছিটকে পড়েছে তারা।

ইরান চীনের চেয়ে আকারে ছোট হলেও দেশটির বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রতিবাদী বৈদেশিক নীতির কারণে এর একটি স্বকীয়তা রয়েছে। নতুন চুক্তি ইরান ও আমেরিকার মধ্যে দ্বন্দ্বের রসদ যোগাবে। তেহরান এবং ওয়াশিংটনে বাইডেন প্রশাসন—দু’পক্ষই বলেছে, তারা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণবিষয়ক চুক্তিতে আবারো যুক্তরাষ্ট্রের যোগ দেয়ার পক্ষে।

এই চুক্তি যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা (জেসিপিওএ) হিসেবে পরিচিত। ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই সাথে চুক্তিটিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি। তিনি দাবি করেছিলেন, ইরানকে পরমাণু অস্ত্র লাভে নিরস্ত্র করার চেয়ে তার প্রক্রিয়া বেশি সহজ ছিল।

ইরানি এবং আমেরিকানরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ছিল; দু’পক্ষেরই আশা ছিল অপরপক্ষ প্রথম পদক্ষেপটি নিক। কারণ কেউই আসলে আগে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তৈরি ছিল না।

এখন চীনের সাথে যেহেতু ইরান একটি চুক্তি সই করেছে এবং এই দেশটিও যেহেতু জেসিপিওর অংশ, তাই ধারণা করা হচ্ছে, সহযোগিতা শুধু তেল বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। কারণ নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে ইরানের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমঝোতায় ইরানকে সুবিধা দেবে বলে ধরা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার দুই পূর্বসূরির মতোই মধ্যপ্রাচ্য থেকে নজর সরিয়ে আরো আকর্ষণীয় ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দিকে বেশি নজর দিতে চান। কিন্তু কার্যত এটা অসম্ভব, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এমন বিষয় প্রচুর পরিমাণেই রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। এই বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইরান এবং এর পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা; যেটি তাদের নেই বলে দাবি করে ইরান।

যদিও মধ্যপ্রাচ্য থেকে নজর সরায়নি যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সামনে এগোয়নি তারা। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অবস্থান আরো পোক্ত করার অনিচ্ছা তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য সুযোগ বয়ে এনেছে। সিরিয়ার যুদ্ধে জড়ানোর মাধ্যমে রাশিয়া ওই অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুগের ভূমিকা পুনরুদ্ধারের একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে।

চীনের বিশ্বাস— দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের অপূরণীয় পতন হবে। চীন নিজেকে একবিংশ শতাব্দী ও পরবর্তী বিশ্বের উদীয়মান শক্তি হিসেবে মনে করে। আর এ পর্যায়ের শক্তিধর কোন রাষ্ট্র আসলে মধ্যপ্রাচ্যকে বাদ দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে না।

ইরানের মতো স্বল্পমেয়াদে সুবিধা নেওয়ার চেয়ে কৌশলগত এই সহযোগিতা হয়তো উপসাগরীয় অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদে চীনের জন্য বেশি গুরুত্ব বহন করে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এর মধ্যপ্রাচ্য সফর শুধু তেহরানে চুক্তি সইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র চায়না ডেইলি বলেছে, তিনি পঞ্চমুখী একটি পরিকল্পনার সূচনা করেছেন; যার উদ্দেশ্যে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল আলোচনা শুরু, ইরানের পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবন এবং এই এলাকায় একটি সুরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলে মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা।

এ ধরনের বিষয়গুলো পশ্চিমা কূটনীতিকরাও বলে থাকেন। তবে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের অধিকারে আছে বলেই ধরে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি তাই চেক সই করা ছাড়া অন্য ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিত্রদের মধ্যপ্রাচ্য থেকে দূরেই রেখেছে।

লোহিত সাগরে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি ইতোমধ্যে তাদের প্রথম বৈদেশিক সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে; যেটি পড়েছে জিবুতিতে। এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত জাহাজ চলাচল অঞ্চলের ওপর নজরদারি করে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর আফ্রিকা কমান্ড থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।

বেইজিং কি ইরান উপসাগরীয় এলাকায় তাদের নৌবাহিনীর পদচিহ্ন আঁকতে চায়, যে এলাকাকে নিজের হ্রদ বলে মনে করে আমেরিকা? জো বাইডেন এবং তার প্রশাসন হয়তো ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি বা জেসিপিওএ-তে ফিরে আসার একটা পথ বের করে নেবে। নিজেদের স্বার্থেই তারা এটি করবে। তবে বিশ্বের সবচেয়ে অস্থিতিশীল এলাকায় চীন যে তাদের অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টায় গতি আনার ইঙ্গিত দিচ্ছে সেটা আমেরিকার জন্য অস্বস্তিকর হবে। বিবিসি বাংলা।

এসএস