মিয়ানমারে গত ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে চলমান গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৪৩ শিশুর প্রাণ গেছে। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন ও অধিকার সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি পীড়াদায়ক পরিস্থিতিতে রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতায় নিহত গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শিশুটির বয়স ছিল মাত্র সাত বছর।

অন্যদিকে, স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিজনারস (এএপি) বলছে, গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনে ৫৩৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সামরিক বাহিনী কঠোর অভিযান শুরু করায় দেশটিতে ‘রক্তবন্যার ঝুঁকি’ তৈরি হয়েছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের দূত।

জাতিসংঘ এমন এক সময় এই সতর্কবার্তা দিলো, যখন দেশটির সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে সেনাবাহিনী এবং জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহীগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নতুন করে সংঘর্ষ ছড়িয়েছে।

এক নজরে মিয়ানমার

• মিয়ানমার; বার্মা নামে পরিচিত
• ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে
• আধুনিক ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় সামরিক শাসনের অধীনে কেটেছে
• ২০১০ সালে দেশটিতে বিধি-নিষেধ শিথিল হতে শুরু করে
• ২০১৫ সালে ১ম অবাধ নির্বাচন, সরকারের নেতৃত্বে অং সান সু চি
• ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাবিরোধী প্রাণঘাতী সামরিক অভিযান শুরু
• অভিযানের মুখে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাংলাদেশে পলায়ন
• রাখাইনে জাতিগত নিধন অভিযান চালানোর অভিযোগ করেছে জাতিসংঘ

গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে দেশটির নেত্রী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আবারও ক্ষমতায় আসে। সামরিক বাহিনী এই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুললেও নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়ে দেয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই মাস আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এক বছরের জন্য দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে। তখন থেকে প্রায় প্রত্যেকদিন মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীরা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন।

লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ করায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের ছত্রভঙ্গ করতে শুরুর দিকে জলকামানের ব্যবহার করে। এর এক সপ্তাহ পর বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট এবং তাজা গুলি ব্যবহার করে জান্তা নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা বাহিনী।

জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে পরিবারের সদস্যদের সাথে অংশ নিতে দেখা যায় শিশুদেরও

তবে দেশটিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন গেছে গত শনিবার; ওইদিন নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শতাধিক বিক্ষোভকারীর প্রাণহানি ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, সামরিক বাহিনী রাস্তায় জনগণের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করেছে। এমনকি কিছু কিছু বিক্ষোভকারীকে তাদের বাড়িতে ঢুকে সেনাসদস্যরা হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত সাত বছর বয়সী মেয়ে শিশু খিন মিও চিটের পরিবারের সদস্যরা বিবিসিকে বলেছেন, মার্চের শেষের দিকে মান্দালয়ে তাদের বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। খিন মিও তার বাবার কাছে দৌড়ে যাওয়ার সময় পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে।

খিন মিওয়ের বোন মে থু সুমাইয়া (২৫) বলেন, ‘তারা দরজা খোলার জন্য লাথি মেরেছিল। দরজা খুলে যাওয়ার পর তারা আমার বাবার কাছে জানতে চায় বাড়িতে অন্য কেউ আছে কি না। বাবা ‌‘না’ বললে তারা মিথ্যাচারের অভিযোগ করে এবং বাড়িতে তল্লাশি শুরু করে।’

এমন মুহূর্তে খিন মিও চিট বাবার কাছে দৌড়ে যায় উল্লেখ করে সুমাইয়া বলেন, ‌‘খিন দৌড় শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গুলি ছোড়ে এবং সে (খিন) গুলিবিদ্ধ হয়।’ সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, গুলিতে নিহত শিশুদের মধ্যে ১৪ বছর বয়সী একজনও রয়েছে; মান্দালয়ে বাড়ির ভেতরে অথবা কাছে সে গুলিতে নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ইয়াঙ্গুনের সড়কে খেলাধুলা করার সময় ১৩ বছর বয়সী এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, মিয়ানমারে সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ৪৩ শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে

দেশটিতে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে আহত শিশুদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য বলে সতর্ক করে দিয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেন। আন্তর্জাতিক এই সংস্থা বলছে, এক বছর বয়সী এক মেয়ে শিশু চোখে রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছে। মিয়ানমারের এই সহিংসতা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে বলে সতর্ক করে দিয়েছে সংস্থাটি।

সেভ দ্য চিলড্রেনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‌‘মিয়ানমারের শিশুরা সহিংসতা এবং ভয়ানক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছে। এটি পরিষ্কার যে, শিশুদের জন্য মিয়ানমার আর নিরাপদ স্থান নয়।’

সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স।

এসএস