সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ এবং গণতন্ত্রের দাবিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চালিয়ে আসা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। সেনা সদস্যদের গুলি থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারী ও শিশুরাও। আর এতে করে নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়েছে দেশটির জান্তা সরকার ও সামরিক বাহিনী।

স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারস (এএপিপি) বলছে, গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকে এখন পর্যন্ত অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনে ৫৪৩ জনের বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে ৪৪ জন শিশুও রয়েছে। এছাড়া গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৭০০ জনকে।

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতা ও দমনপীড়ন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন ও অধিকার সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত ১২ দিনে সামরিক বাহিনীর গুলিতে বার্মিজ শিশু ও অল্পবয়সীদের মৃত্যু দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, ‘সামরিক বাহিনীর প্রাণঘাতী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে শিশুরাও, এতে আমরা খুবই ব্যথিত। যদিও যেকোন ধরনের হামলা সহিংসতা ও ক্ষতি থেকে শিশুদের রক্ষা করতে বারবার জান্তা সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহত এসব শিশুদের অনেককে তাদের বাড়িতেই হত্যা করা হয়েছে, যেখানে তাদের নিরাপদেই থাকার কথা ছিল।’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানিয়েছে, মিয়ানমারে শত শত মানুষকে জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে। এসব মানুষের অবস্থান জানাতে এমনকি আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎও প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে।

এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া অঞ্চলের ডিরেক্টর ব্রাড অ্যাডামস বলছেন, ‘অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখাতে মিয়ানমারের জান্তা সরকার নির্বিচারে গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা ও তাদের মধ্যে অনেককে গুম করছে। আর তাই জান্তা সরকার ও সামরিক বাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে তাদের বিরুদ্ধে এখনই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত।’

এদিকে মিয়ানমার নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা মিয়ানমারের পরিস্থিতিতে খুবই উদ্বিগ্ন। যেভাবে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে, নারী-শিশুসহ শত শত বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হচ্ছে, তাতে উদ্বেগ বেড়েছে।

অবশ্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মূল বিবৃতিটি ছিল আরও কড়া। কিন্তু চীনের হস্তক্ষেপে তা কিছুটা নরম করা হয়। প্রথমে যে বিবৃতি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তাতে বলা ছিল- নিরাপত্তা পরিষদ পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাববে। সেখানে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। দুই দিন ধরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলে। চীন ওই কড়া ভাষা ব্যবহার করতে দিতে রাজি হয়নি। তারপর বিবৃতি কিছুটা নরম করে দেওয়া হয়।

এছাড়া মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বাণিজ্যিক স্বার্থের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ব্রিটেন। তবে এতো কিছুর পরও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ও শক্তিপ্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে জান্তা সরকার।

স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, শুক্রবারও মিয়ানমারজুড়ে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে। দেশের বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনে সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহতদের স্মরণে বাস স্টপেজসহ বিভিন্ন স্থানে ফুল রেখেছে বিক্ষোভকারীরা।

গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে দেশটির নেত্রী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আবারও ক্ষমতায় আসে। সামরিক বাহিনী এই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুললেও নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়ে দেয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই মাস আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এক বছরের জন্য দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে। তখন থেকে প্রায় প্রত্যেকদিন মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীরা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন।

লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ করায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের ছত্রভঙ্গ করতে শুরুর দিকে জলকামানের ব্যবহার করে। এর এক সপ্তাহ পর বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট এবং তাজা গুলি ব্যবহার করে জান্তা নিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা বাহিনী।

তবে দেশটিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন গেছে গত শনিবার; ওইদিন নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শতাধিক বিক্ষোভকারীর প্রাণহানি ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, সামরিক বাহিনী রাস্তায় জনগণের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করেছে। এমনকি কিছু কিছু বিক্ষোভকারীকে তাদের বাড়িতে ঢুকে সেনাসদস্যরা হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সূত্র: এএফপি

টিএম