ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের নূহ জেলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শুরু হয়েছিল ৩১ জুলাই। সেখান থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সোহনাতেও ছড়িয়েছিল সেই উত্তেজনা। ভাঙচুর চালানো হয় একটি মসজিদে। মুসলমানদের বাঁচাতে সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন প্রতিবেশী শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ।

সোহনার জামে মসজিদের ইমাম কলিম কাশফি যখন নূহর ঘটনা জেনেছিলেন। তারপর থেকেই তার মনে আশঙ্কা হচ্ছিল যে, তার এলাকাতেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে।

কিন্তু তিনি নিজের মনকে এই বলে প্রবোধ দিয়েছিলেন, তার পরিবার কয়েক দশক ধরে যে এলাকায় বাস করছে, বা বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে যখন দেশজুড়ে দাঙ্গা হচ্ছিল, তখনও তার জামে মসজিদের কোনও ক্ষতি হয়নি। এবারেও কোনও হামলা হবে না বলেই ভেবেছিলেন কলিম কাশফি।

তবে আগের রাতেই গুরগাঁও শহরের ৫৭ নম্বর সেক্টরে একটি মসজিদে হামলা চালিয়ে সেখানকার নায়েব ইমামকে হত্যা করেছিল দাঙ্গাকারীরা। তাই স্থানীয়রা শাহী জামে মসজিদের ইমাম কলিম কাশফিকে সাবধান করেছিলেন।

• শান্তি কমিটির বৈঠকের পরও অশান্তি

নূহ এলাকার দাঙ্গার পরের দিন সোহনায় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা আর পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ে একটি শান্তি কমিটির বৈঠক হয়। শহরের সব সম্প্রদায় একসঙ্গে থাকবে, এই সিদ্ধান্তও হয়। বৈঠকের আগে অবশ্য স্থানীয় পৌর প্রতিনিধির স্বামী গুরবচন সিং কাশফিকে সতর্ক করেছিলেন এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে তিনি কোনও নিরাপদ জায়গায় চলে যান।

তবে বৈঠকের পরে সিংয়ের মত বদলায়, তিনি কলিম কাশফিকে বলেছিলেন, এখন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

• আলাউদ্দিন খিলজির নির্দেশে মসজিদ নির্মাণ

শাহী মসজিদের একটি অংশে ইমাম ও তার ভাইদের পরিবার বসবাস করে। নূহর ঘটনার পর মসজিদের নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কলিম কাশফি বলেন, প্রশাসন ও আশপাশের লোকজন আমাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল। পুলিশও হাজির ছিল, তাই ভয়ের মধ্যেও আমরা পরিবারসহ এখানেই থেকেছি।

সোহনায় মুসলমানদের সংখ্যা সামান্য, আর শাহী জামে মসজিদের আশপাশে মাত্র কয়েক ঘর মুসলমানের বসবাস। ইমামের যৌথ পরিবারে রয়েছে প্রায় ৪০ জন সদস্য। শাহী জামে মসজিদের সঠিক ইতিহাস পাওয়া না গেলেও স্থাপনাটি দেখে মনে হয় এই মসজিদটি কয়েক শতাব্দির পুরোনো।

ইমাম কলিম কাশফির মতে, মসজিদটি আলাউদ্দিন খিলজির নির্দেশে নির্মিত হয়েছিল। তিনটি বড় গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি একটু উঁচু জমিতে নির্মিত। এর একপাশে বারোটি স্তম্ভ বিশিষ্ট একটি বিশাল গম্বুজ এবং এর সংলগ্ন একটি মাজারের মতো ভবন যেখানে ইমাম ও তার পরিবারের সদস্যরা এখন বসবাস করছেন।

• লুকিয়ে থেকে হামলার ভিডিও

গত ১ আগস্ট দুপুর ১টার দিকে ইমাম কাশফি খবর পাচ্ছিলেন, মসজিদে হামলা হতে পারে। তিনি নিজের পরিবারকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেন। কলিম কাশফির কথায়, দুই থেকে তিনজন যুবক মসজিদের দেয়াল টপকে ভেতরে চলে আসে। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় থানায় বিষয়টি জানাই। থানা থেকে ওসি পৌঁছে হামলা করতে আসা ওই যুবকদের তাড়িয়ে দেন।

‘কিন্তু কয়েক মিনিট পর প্রচুর মানুষ অন্যদিক থেকে মসজিদে হামলা চালায়। একটা সময়ে পুলিশও তাদের সামনে অসহায় হয়ে পড়ে,’ জানান কাশফি।

মসজিদেই সে সময়ে ছিলেন কাশফির ভাতিজা সাদিক। ভিড় এগিয়ে আসতে দেখে তিনি আবাসিক অংশের সদর দরজা বন্ধ করে দেন। রান্নাঘর থেকে তিনি ওই হামলা দেখছিলেন, সেখান থেকেই ঘটনার একটি ছোট ভিডিও করেন।

সাদিক ব্যাখ্যা করেন, আমরা বাড়ির নারী ও শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে, আমরা তাদের গম্বুজের দিকটায় চলে যেতে বলি, যাতে হামলাকারীরা তাদের দেখতে না পায়। আমরা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলাম যাতে মনে হয় ভেতরে কেউ নেই।

তার রেকর্ড করা ভিডিওতে দেখা যায়, অস্ত্র নিয়ে হামলাকারীরা মসজিদ ভাঙচুর করছে।

• যেভাবে এগিয়ে আসেন শিখরা

ওই সময় স্থানীয় পৌর প্রতিনিধির স্বামী গুরবচন সিং জানতে পারেন, মসজিদে ইমাম ও তার পরিবার আটকা পড়েছে। সেখানে হামলা হচ্ছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এলাকার শিখ যুবকদের জড়ো করে মসজিদের দিকে এগিয়ে যান।

গুরবচন সিং বলেন, স্থানীয় পুলিশ দাঙ্গাকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পুলিশের সংখ্যা কম ছিল। আমাদের এগিয়ে যেতে দেখে পুলিশও ভরসা পায়। আমরা যখন মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করি ততক্ষণে দাঙ্গাকারীরা পালিয়ে গেছে।

‘পুলিশের সঙ্গে আমরা ইমাম ও তার পরিবারকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা ইমাম সাহেবকে বললাম, তিনি যদি আমাদের সঙ্গে থাকতে চান, থাকতে পারেন।’

গুরবচন সিং কি এই সময় ভয় পেয়েছিলেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা শুধু জানতাম যে জীবন বাঁচানো আমাদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য। আমরা ছোটবেলা থেকেই ইমাম ও তার পরিবারকে চিনি। আমরা শুধু আমাদের ধর্ম পালন করছিলাম।

মসজিদ থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে শিখদের একটা বড় এলাকা আছে। এখানে প্রায় ৩০০ শিখ পরিবার থাকে, রয়েছে একটা বড় গুরুদ্বারও।

একজন শিখ ব্যক্তি তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানকার শিখরা মুসলিম ভাইদের সাহায্য করতে গিয়েছিল। কারণ তাদের ধর্ম কী তা বিবেচ্য নয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তাদের জীবন বাঁচাতে হবে।

• থমকে গেছে মসজিদের ঘড়ি

ইমামের ভাতিজা সাদিক বলেন, পুলিশ যখন দাঙ্গাকারীদের তাড়া করছিল, তখন আশপাশের শিখরা চলে এসেছিল। তারা জানতে চাইছিল, আমরা ঠিক আছি কি না বা কারও কোনও আঘাত আছে কি না। আমরা যদি কোথাও চলে যেতে চাই তাহলে ওরা গাড়ি করে পৌঁছে দেওয়ার কথাও বলেছিল। কিন্তু পরে প্রশাসন একটি বাসের ব্যবস্থা করে, সেটিতেই আমাদের পরিবারকে পুলিশি পাহারায় নিরাপদ জায়গায় রেখে আসে তারা।

ইমাম কলিম কাশফি বলেন, আমাদের প্রতিবেশীরা পাশে থাকায় খুব ভরসা পেয়েছিলাম। হামলার সময় শিখ ভাইরাও যেমন এসেছিলেন, তেমনই পাশেই যে সাইনি হাসপাতাল আছে, তারাও এসে খোঁজ নিয়ে গিয়েছিল আমাদের।

হামলার সময় দাঙ্গাকারীরা মসজিদের পাশে পার্ক করা গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহন ভাঙচুর করে। মসজিদে রাখা ওয়াটার কুলার, চেয়ার ও ফ্যানও ভেঙে ফেলা হয়েছে। হামলার পর মসজিদ পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু এখনও সর্বত্র আক্রমণের চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে ইমাম খুতবা দেন, সেটাও ভেঙে ফেলা হয়েছে। উপড়ে পড়েছে বৈদ্যুতিক বোর্ড। মজবুত দরজাতেও ফাটল ধরেছে। লাঠির আঘাতে মসজিদের ঘড়িটি একই সময়ে থেমে আছে। এখনও সময় দেখাচ্ছে দুপুর দেড়টা।

• ক্ষত মুছবে?

সাদিকের কথায়, হামলাকারীরা যা পেয়েছে, ভাঙচুর করেছে। আমাদের বাড়ির নারী আর শিশুরা আটকা পড়েছিল। আমরা সবাই প্রায় দম বন্ধ করে বসেছিলাম। তারা যদি জানত যে আমরা ভেতরে আছি, তাহলে দরজা ভাঙার চেষ্টাও করত।

একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন সাদিক এবং সহিংসতার পর থেকে অফিসে যাচ্ছেন না। তিনি এখন বাড়ি থেকে কাজ করছেন। এই হামলার ফলে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা হবে, কিন্তু আমাদের মনের ক্ষতটা মুছে ফেলা সহজ নয়, বলেন সাদিক।

সাদিকের খালার ছেলে সুহেলও সেখানেই থাকেন এবং গুরগাঁওতে কাজ করেন। হামলার সময় সুহেলও মসজিদেই ছিলেন। তার কথায়, এই ঘটনা ভুলে যাওয়া আমাদের পক্ষে সহজ হবে না। পুলিশ গুলি না চালালে এখানে অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারত।

বর্তমানে জামে মসজিদে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এখন পরিস্থিতি শান্ত, তবে উত্তেজনাও রয়েছে। এখান থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন ইমামের পরিবারের নারীরা।

কলিম কাশফির কথায়, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু তার মনে যে ভয় ঢুকে গেছে, তা থেকে কি বেরিয়ে আসতে পারবেন তিনি? কাশফি বলেন, আমরা চিন্তাও করতে পারিনি যে এরকম হামলা হতে পারে। কিন্তু মসজিদ ছেড়ে আমরা কোথায় যাব? কার হাতে ছেড়ে যাব এই ঐতিহ্য?

গুরগাঁও পুলিশ এই হামলার ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। সোহনার এসিপি নবীন সিন্ধু বলেছেন, আমরা এখন তদন্ত করছি। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিবিসি বাংলা।

এসএস