ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে গত ২৬ ফেব্রুয়ারির সফর ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, অল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশে গিয়েও নরেন্দ্র মোদি সেখানে সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়ে এসেছেন।

ওই সফরে মোদি আসলে পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারই চালিয়েছেন বলে এর আগে অভিযোগ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশটির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অবশ্য যথারীতি এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছে এবং প্রকাশ্যেই বলছে, বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য সহমর্মিতা দেখানোতে কোনো অন্যায় নেই।

মাত্র দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফর সেরে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ থেকে ফিরেছেন প্রায় ১০ দিন হয়েছে। কিন্তু ওই সফর ঘিরে এখনও আলোড়িত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতি।

মোদির সফরের সময় বাংলাদেশের নানা প্রান্তে যে সহিংস বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ হয়েছে, তার প্রতি ইঙ্গিত করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রোববার বিকেলে হুগলি জেলার খানাকুলে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রীকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন।

তিনি বলেন, আপনি আগে দিল্লি গিয়ে দিল্লিটা সামলান তো! দিল্লির তো সর্বনাশ করে দিয়ে এসেছেন! তিনদিনের জন্য বাংলাদেশ গিয়েছিলেন। ওখানে গিয়েও সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়ে এসেছেন। আগে নিজেকে সামলান! আর আপনি নিজেকে কী ভাবেন? অতিমানব না কি ঈশ্বর? দাঙ্গা করে, খুন করেই আবার আপনাদের চোখ দিয়ে জল পড়ে! ভালো নাটকও করতে জানেন আপনারা!

এর আগেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন, বাংলাদেশ সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি আসলে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের প্রচার চালাচ্ছেন; তাই তার সে দেশের ভিসা বাতিল করা উচিত।

যশোর ও গোপালগঞ্জে হিন্দুদের দু’টি মন্দিরে মোদির সফরের পটভূমিতেই তিনি ওই মন্তব্য করেন। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা ও মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য দাবি করছেন, বিদেশ সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী অভ্যন্তরীণ রাজনীতির তাস খেলেছেন, মানুষ সে কথা বিশ্বাস করবেন না।

তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ডিএনএতে রাজনীতি আছে। তারা খুব ভালো জানেন দেশের প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন কোনো বিদেশ সফরে থাকেন; তখন তাদের কোনো পদক্ষেপ নিয়ে দেশের ভেতরে প্রশ্ন তোলা বা বিবৃতি দেওয়া যায় না। কিন্তু তৃণমূল এসব রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ধার ধারে না।

শমীক ভট্টাচার্য বলেন, আমি তো পাল্টা প্রশ্ন তুলব, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে গিয়ে কোন সহিংসতা ছড়িয়েছেন? বরং তৃণমূলই এখন পশ্চিমবঙ্গে যে কোনোভাবে একটা দাঙ্গা বাঁধাতে চাইছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের যশোরেশ্বরী মন্দির কিংবা মতুয়া তীর্থস্থান ওড়াকান্দিতে মোদির সফর কি এড়ানো যেত না? শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে গিয়ে হিন্দু মন্দিরে যাবেন না তো কি চীনে গিয়ে মন্দির দর্শন করবেন?

‘সেখানে যে হিন্দুরা রয়ে গিয়েছেন, তাদের জীবন-যৌবন, মানসম্ভ্রম, ধনসম্পত্তি, ধর্মবিশ্বাস-ধর্মস্থান সব লুট হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষগুলোর জন্যই আমরা সেই ১৯৫২ সাল থেকে লড়াই করছি। হিন্দুরা সেখানে আজও আছেন তাদের আমরা অস্বীকার করতে পারি না। কারণ তারা আমাদের রক্ত, আমাদের ভাই।’

শমীক ভট্টাচার্য বলেন, তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ও দেশের ভেতরেও আমরা সদা সচেষ্ট থাকব। বিজেপি নেতৃত্ব হিন্দুদের প্রতি সংহতির কথা বললেও কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয়তে সরাসরি লিখেছে, করোনাকালীন প্রথম বিদেশ সফরকে নরেন্দ্র মোদি যে ঘরোয়া রাজনীতির স্বার্থেই ব্যবহার করেছেন— তা একেবারে স্পষ্ট।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অভীপ্সু হালদার বিবিসিকে বলেন, বিজেপি যে দেশের ভেতরে এই সফরের রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে তাতে কোনো ভুল নেই।

অধ্যাপক হালদারের কথায়, পশ্চিমবঙ্গের যে কেন্দ্রগুলোতে মতুয়া হিন্দুদের ভোট আছে, প্রধানমন্ত্রীর মতুয়া তীর্থদর্শন সেগুলোতে তাদের ভাবাবেগ কাছে টেনে বিজেপিকে সুফল এনে দেবে, এমনটা ভাবা যেতেই পারে। দ্বিতীয়ত— ভারতের অভিবাসন নীতি। দেশের শাসক দল যে এই নীতি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে এবং এর নৈতিকতা খতিয়ে দেখছে সেটাও আমরা জানি।

‘সেই ভাবনারই প্রতিফলন হল ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন। সেটারই সূত্রে কিন্তু সার্বিকভাবে বাংলাদেশ নিয়ে বা মতুয়াদের নিয়ে ভোটে এত মাতামাতি হচ্ছে বলে আমার ধারণা। জাতপাত ও ধর্ম নিয়ে একটা রাজনৈতিক মেরুকরণ যে চলছে, তারও একটা ব্যাখ্যা আমরা এখানে পেতে পারি।’ বিবিসি বাংলা।

এসএস