ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একজন আইনপ্রণেতা দেশটির পার্লামেন্টের ভেতরে অন্য এক মুসলিম এমপিকে উদ্দেশ্য করে ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য করেছেন। এমনকি মুসলিম ওই এমপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক অপবাদমূলক ভাষাও ব্যবহার করেছেন তিনি।

এদিকে মুসলিম এমপিকে উদ্দেশ্য করে করা ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যের ভিডিও ফুটেজও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের ঐতিহাসিক চাঁদ মিশনের সাফল্যের বিষয়ে বৃহস্পতিবার ভারতীয় পার্লামেন্টে বিতর্ক চলাকালীন ক্ষমতাসীন বিজেপির আইনপ্রণেতা রমেশ বিধুরি মুসলিম এমপি কুনওয়ার দানিশ আলীকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। এমনকি দানিশ আলীকে ‘সন্ত্রাসী ও ‘দালাল’ বলেও আখ্যা দেন তিনি।

ভুক্তভোগী মুসলিম এমপি কুনওয়ার দানিশ আলী দেশটির বিরোধী দল বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) সদস্য। অন্যদিকে রমেশ বিধুরি ভারতের রাজধানী দক্ষিণ দিল্লির নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য।

পার্লামেন্টে ভাষণ দেওয়ার সময় মুসলিম এমপি কুনওয়ার দানিশ আলীকে লক্ষ্য করে রমেশ বিধুরিকে বলতে শোনা যায়, ‘তুমি চরমপন্থি... আমি তোমাকে বলছি, তুমি খতনা করেছ।’

মূলত চরমপন্থি শব্দটি ভারতে মুসলমানদের উদ্দশ্য করে গালি হিসেবে প্রায়ই ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছে আল জাজিরা। এমনকি ভাইরাল সেই ভিডিওর শেষের দিকে মুসলিম এমপিকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া স্পষ্ট হুমকিতে বিধুরি বলেন, ‘আমি এই মোল্লাকে বাইরে দেখে নেবো।’

আল জাজিরা বলছে, ‘মোল্লা’ দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের জন্য আরেকটি নিন্দনীয় শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর পার্লামেন্টে মুসলিম এমপিকে উদ্দেশ্য করে বিজেপির রমেশ বিধুরি যখন এসব ভাষায় কথা বলছিলেন তখন তার পাশে বসে অন্তত দুইজন সিনিয়র বিজেপি নেতা এবং সাবেক একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে হাসতে দেখা যায়।

এদিকে সদ্য উদ্বোধন হওয়া পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরে ইসলামবিদ্বেষী এই মন্তব্য দেশটির বিরোধী দল এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তারা অভিযুক্ত বিধুরির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

অন্যদিকে মুসলিম এমপি কুনওয়ার দানিশ আলী আল জাজিরাকে বলেছেন, বিজেপির রমেশ বিধুরির এই মন্তব্যে তিনি বিচলিত এবং আহত হয়েছেন, কিন্তু ‘চমকে যাননি বা বিস্মিত হননি’। তিনি বলেন, ‘আমি মোহন ভাগবত এবং প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র) মোদিকে জিজ্ঞাসা করতে চাই: আরএসএস কি তাদের স্কুলে তাদের ক্যাডারদের এটাই শেখায়?’

আরএসএস বলতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা স্বেচ্ছাসেবকদের জাতীয় সমিতিকে বোঝায় যারা ক্ষমতাসীন বিজেপির অতি-ডান মতাদর্শিক পরামর্শদাতা। এই সংঘের লক্ষ্য বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারতকে একটি জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর মোহন ভাগবত হচ্ছে আরএসএস-এর প্রধান।

দানিশ আলী বলেন, যদি একজন নির্বাচিত আইনপ্রণেতাকে পার্লামেন্টের ভেতরে এভাবে হুমকি দেওয়া যায়, তাহলে ‘দেশের সাধারণ একজন মুসলমান কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন সে সম্পর্কে অনেক কিছুর উত্তর পাওয়া যায়’।

তিনি বলেন, বিতর্কের সময় পার্লামেন্টে উপস্থিত বিরোধী দলের সদস্যরা তার পক্ষে দাঁড়ান। তিনি আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘কংগ্রেস এবং টিএমসি (তৃণমূল কংগ্রেস) এর আইনপ্রণেতারা, বিশেষ করে নারী সংসদ সদস্যরা এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন।’

এদিকে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে পার্লামেন্টের ভেতরে মুসলিম এমপিকে হুমকি দেওয়ার ভিডিও প্রথম প্রকাশ করেন টিএমসি সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্র। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া পোস্টে তিনি বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডাকে জিজ্ঞাসা করেন, কট্টর-ডানপন্থি এই দল এই ঘটনায় বিধুরির বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিতে চলেছে কিনা।

তিনি বলেন, ‘মুসলিমদের ও ওবিসি-দের গালাগালি করা বিজেপির সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।’

প্রসঙ্গত, ভারতে ওবিসি বলতে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ‘অন্যান্য অনগ্রসর জাতি’-কে বোঝানো হয়ে থাকে।

অন্যদিকে ভারত-শাসিত কাশ্মিরের রাজনীতিবিদ ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ‘আগে কখনও হয়নি’। এক্সে তিনি লিখেছেন, ‘বিদ্বেষপূর্ণ (মাননীয়) এই এমপি কত সহজে এসব কখা বললেন! যেসব মুসলিমরা বিজেপিকে তাদের নিজেদের দল হিসাবে মনে করে, তারা কীভাবে এই মাত্রার ঘৃণাকে সঙ্গে নিয়ে পাশাপাশি সহাবস্থান করে?’

ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য জয়রাম রমেশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ থেকে অভিযুক্ত বিধুরিকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি এমন ভাষা কখনও শুনিনি। পার্লামেন্টের ভেতরে বা বাইরে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়। এটা শুধুমাত্র দানিশ আলীর জন্যই নয়, আমাদের সকলেরই অপমান… বিধুরি এবং তার কথার মাধ্যমে একটি নতুন পার্লামেন্টের সূচনা হয়েছে।’

এদিকে পার্লামেন্টের ভেতরে মুসলিম এমপির বিরুদ্ধে এই ধরনের মন্তব্য নিয়ে ক্ষোভ বাড়তে থাকায় ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সাবেক বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘(বিজেপি) সদস্যের মন্তব্যে বিরোধীরা আঘাত পেলে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। এসব মন্তব্য সংসদীয় রেকর্ড থেকেও বাদ দেওয়া হয়েছে।’

ভারতীয় বার্তাসংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) জানিয়েছে, শুক্রবার এই ঘটনা নিয়ে মুখ খুলেছেন ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের স্পিকার ওম বিড়লা। তিনি বলেছেন, ‘যদি এই ধরনের আচরণের পুনরাবৃত্তি হয়’, তাহলে বিধুরির বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে।

তবে ভুক্তভোগী এমপি দানিশ আলী বলছেন, তিনি অভিযুক্ত বিধুরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্পিকারের কাছে আবেদন জানাবেন।

অবশ্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পার্লামেন্টের মধ্যে বিধুরির এই মন্তব্য বিজেপির সদস্য ও সমর্থকদের মুসলিম বিরোধী বক্তব্য এবং গালিগালাজের আরেকটি উদাহরণ মাত্র।

নয়াদিল্লির কাছে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আলী খান মাহমুদাবাদ আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘একজন নির্বাচিত এমপিকে সন্ত্রাসী, জঙ্গি এবং খৎনাকৃত মোল্লা বলা আশ্চর্যজনক নয়, কারণ এই ভাষাই ইতোমধ্যে ভারতে নানা সমাবেশ ও প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়েছে।’

টিএম