ইসরায়েল এবং গাজায় চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া মিথ্যা দাবি, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং বিদ্বেষমূলক উপাদানে ভরে গেছে। বেশ কিছু ফেক অ্যাকাউন্ট বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
 
গত সপ্তাহের শুরুর দিকে টিকটকে একটি ভিডিও ছড়ায় যেখানে দেখা যায় হামাসের যোদ্ধারা এক ইসরায়েলি তরুণীকে জিম্মি করছে। ৭ অক্টোবর প্রকাশিত ভিডিওটি ছিল খুবই ভীতিকর।
 
পোস্টটিতে মানুষের মন্তব্যগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায় কেউ কেউ এতে শোকাহত হয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, ফুটেজে যা দেখা যাচ্ছে বাস্তবে ঘটনা ঠিক সেরকম নয়।

কেউ কেউ বলেন, ওই নারী বেসামরিক নন, তিনি একজন সৈনিক অথবা হামাসকে ফাঁসানোর জন্য তৈরি করা ক্লিপটি ভুয়া। 

কেউ কেউ দাবি করেছেন যে হামাস গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জিম্মিদের সাথে সহিংসতা চালানোর কোনো প্রমাণ নেই।

টিকটকের ভিডিওটিতে দেখা যায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা এক তরুণীকে বন্দুকধারীরা গাড়ির ভেতর ঠেলে দিচ্ছে। এটি গাজা শহরের উপকণ্ঠে শিজিয়ায় রেকর্ড করা হয়েছিল।

অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া সাইটেও এ ধরনের ভিডিও ছড়িয়েছে। ভুল তথ্যগুলো জিম্মিদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে ছোট করার চেষ্টা করে এমন অ্যাকাউন্টেই সীমাবদ্ধ নয়। ইসরায়েলি সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থন করা প্রোফাইলগুলো থেকেও বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

গত সপ্তাহে এমন একটি ভিডিওতে দেখা যায় ফিলিস্তিনিরা গাজায় আহত হওয়ার অভিনয় করছে।

ক্লিপটি মূলত ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে নেওয়া হয়েছিল যেখানে একজন মেকআপ শিল্পী ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্রের কাজ করছিলেন।

এসব বিভ্রান্তিকর পোস্টের উৎস সব সময় সনাক্ত করা না গেলেও কখনও কখনও এগুলোর উৎস সনাক্ত করা সহজ।

উদাহরণস্বরূপ, পপ তারকা জাস্টিন বিবার ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট শেয়ার করে মানুষকে ‘ইসরায়েলের জন্য প্রার্থনা’ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে ছবিটি শেয়ার করেছিলেন সেটি গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দ্বারা সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের ছবি ছিল।

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ এমন অনেক অ্যাকাউন্ট রয়েছে যা প্রতিটি সংকট সম্পর্কে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে থাকে। এই অ্যাকাউন্টগুলো বিভ্রান্তিকর পোস্টগুলো প্রচার করে থাকে, হয় প্রকৃতপক্ষে যা ঘটছে তা আরও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করতে অথবা ছোট করে দেখাতে।  

বিভিন্ন যুদ্ধের পুরোনো ভিডিও এবং ভিডিও গেমসের ফুটেজ এসব অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করে সেগুলো গাজার বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত বলে দাবি করা হচ্ছে।

ইসরায়েলপন্থী এবং মুসলিমবিরোধী পোস্টগুলো শেয়ার করা কিছু অ্যাকাউন্ট ভারতের বলে মনে করা হচ্ছে। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সমর্থন করা হয়। 

এসব অ্যাকাউন্টের পেছনে কারা?
জিম্মিদের বেসামরিক নাগরিকের পরিবর্তে সৈন্য হিসাবে দেখানো হয়েছে— এমন কিছু অ্যাকাউন্ট আসল অ্যাকাউন্ট বলেই মনে করা হচ্ছে।  

এসব প্রোফাইল থেকে আগে মজার মিম বা ফুটবল ক্লিপও শেয়ার করা হয়েছে।  কেউ কেউ ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ স্লোগান সম্বলিত ছবি পোস্ট করেছেন। যোগাযোগ করলে তারা জানায় তারা পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের।   

তকে কিছু অ্যাকাউন্ট আসল কি না তা নির্ধারণ কঠিন।  

এসব প্রোফাইল থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় যেমন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়েও পোস্ট করা হয়েছে।  

এই অ্যাকাউন্টের অনেকগুলোই সদ্য তৈরি করা বা সম্প্রতি সক্রিয় হওয়া। 
 
অতীতে ইসরায়েল সরকার এবং হামাস দুপক্ষের বিরুদ্ধেই  ‘বট’ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তথ্য বিকৃতির অভিযোগ রয়েছে।  

‘বট’ নেটওয়ার্কে ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলো বারবার এবং দ্রুত বিভাজনমূলক এবং বিভ্রান্তিকর ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশ্লেষণকারী ইসরায়েলি কোম্পানি সায়াব্রার মতে, গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার বিষয়ে যুক্তি দেখানো পাঁচটি অ্যাকাউন্টের মধ্যে একটি ভুয়া।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তারা এক্স ও টিকটকে প্রায় ৪০ হাজার ভুয়া অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করেছে।

এর মধ্যে কিছু প্রোফাইল হামাসের সমর্থনে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ায় এবং দেখানো হয় যে জিম্মিদের প্রতি তারা নম্র আচরণ করছে।  

কিন্তু এর মানে এই নয় যে ইসরাইলের সমর্থন করে এমন কোনো ভুয়া অ্যাকাউন্ট নেই।

অ্যাকাউন্ট আসল কি না তা আমরা পরীক্ষা করতে পারি কয়েকটি উপায়ে। যেমন: যদি নতুন করে কোনো অ্যাকাউন্ট খোলা হয় এবং দেখা যায় হঠাৎ করে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচুর পরিমাণে বিভাজনমূলক, বিভ্রান্তিকর পোস্ট শেয়ার করা হচ্ছে, তবে ওই সব অ্যাকাউন্ট নিয়ে সমস্যার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।  

তবে একটি প্রোফাইল সত্যিই নকল কি না এবং এর পিছনে কারা রয়েছে তা নির্ধারণ করা খুব কঠিন।

এজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। সাংবাদিকদের এসব তথ্য পাওয়ার অধিকার নেই।  

এই সপ্তাহে সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলোতে ব্যাপকভাবে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার কারণে তাদের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সন্ত্রাসবাদপন্থী কনটেন্ট ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানোর জন্য এক্স-এর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে।

এদিকে টুইটারের প্রাক্তন কর্মচারীরা বলছেন নতুন মালিক ইলন মাস্কের আগমনের পরে কর্মীদের ছাঁটাইয়ের পরে সংস্থাটি বিভ্রান্তিকর খবর বন্ধ করতে অক্ষম হয়েছে।

রে সেরাতো বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের দিকে নজর রাখা প্রধান বিশেষজ্ঞরা এখন প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে চলে গেছেন, যাদের কাজ ছিল  ভুল তথ্য ছড়ানো রোধ করা।

গত সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি জানায়, তারা তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে হামাসের সঙ্গে যুক্ত শত শত অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলেছে। 

টিকটক তাদের গাইডলাইনে বলেছে, বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদের প্ল্যাটফর্মে সহিংস, ঘৃণ্য বা বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট প্রতিরোধে বিশেষ রিসোর্স বৃদ্ধি করেছে।

এনএফ