ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হিন্দু দেবতা-রাজা রামের নামে নির্মিত নতুন একটি মন্দিরের উদ্বোধন করছেন। সোমবার জমকালো এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশটির উত্তরপ্রদেশের অযোদ্ধায় নির্মিত এই মন্দিরের উদ্বোধন করবেন তিনি। নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তিন দশকেরও বেশি সময় আগে অযোদ্ধায় বাবরি মসজিদের স্থানে রামের নামে মন্দির নির্মাণের অঙ্গীকার করেছিল। দেশটিতে আগামী নির্বাচনের কয়েক মাস আগে বহুল আলোচিত এই মন্দিরের উদ্বোধনের নেপথ্যে তাই বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণের প্রচারণাও চালানো হচ্ছে জোরেসোরে।

অযোদ্ধায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন ঘিরে দেশটিতে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। কিন্তু এর পেছনে আছে রক্তাক্ত এক সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ইতিহাসও। ২০২০ সালে শুরু হওয়া মন্দিরের নির্মাণকাজ নিয়ে দেশটিতে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল। কারণ ১৯৯২ সালে দেশটির কট্টর হিন্দুত্ববাদী জনতা অযোদ্ধায় ষোড়শ শতকে সম্রাট বাবরের নামে নির্মিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। ওই সময় ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেই সংঘাতে ২ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে; যার বেশিরভাগই ছিলেন সংখ্যালঘু মুসলমান।

মসজিদটি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক সেই জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে রাম মন্দির। ২০১৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অযোদ্ধায় হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয়। দীর্ঘদিনের এক মামলার আইনি লড়াই শেষে আদালত ওই স্থানে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি একই শহরের আরেকটি এলাকায় মুসলমানদের মসজিদ নির্মাণের জন্য জায়গা দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

• নতুন মন্দিরে কী আছে

২০২০ সালে হিন্দুধর্মের প্রধান দেবতাদের একজনের নামে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি মোদি। ২ দশমিক ৭ একর জমিতে একটি কমপ্লেক্সের ভেতর নির্মাণ করা হয়েছে মন্দির। তবে মন্দিরের পুরো এলাকা ৭০ একর জমিজুড়ে বিস্তৃত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাবেক চিফ অব স্টাফ নৃপেন্দ্র মিশ্রের নেতৃত্বে গঠিত একটি প্যানেলের তত্ত্বাবধানে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। মন্দিরের নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন রুপি (১৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। মন্দিরটির জন্য দেশটির প্রায় ৪ কোটি মানুষের কাছ থেকে ৩০ বিলিয়ন রুপি (৩৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সংগ্রহ করা হয়।

• ধর্মীয় বিবাদ কী ছিল?

ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণে অযোধ্যার কথা উল্লেখ আছে। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার পূর্বে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের এই শহরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেবতা রামের জন্মস্থান বলে কথিত আছে। রামকে হিন্দুরা ভগবান বিষ্ণুর অবতার বলে বিশ্বাস করেন।

১৫২৮ সাল থেকে ভারতের প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের শাসনামলে বাবরি মসজিদের স্থানে রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে অনেক হিন্দু বিশ্বাস করেন। রাম যে স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেখানে একটি মন্দির ছিল বলেও তারা দাবি করেন। তাদের বিশ্বাস, বাবরের শাসনামলে সেই মন্দির ভেঙে ফেলার পর সেখানে মসজিদ নির্মাণ করা হয়।

১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনকারীরা বাবরি মসজিদের ভেতরে রামের মূর্তি স্থাপন করার পর কর্তৃপক্ষ মসজিদটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। আদালতের নির্দেশে মসজিদ থেকে মূর্তি অপসারণে নিষেধাজ্ঞা এবং মসজিদ হিসেবে ভবনটির ব্যবহার কার্যকরভাবে বন্ধ করা হয়।

দেশটির হিন্দু ও মুসলিম গোষ্ঠীগুলো অযোদ্ধার ওই এলাকা এবং স্থাপনার ওপর পৃথক দাবি জানিয়ে আদালতের কাছে আবেদন করে। ১৯৮৯ সালে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট মসজিদের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয়।

• কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল মসজিদ?

নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ১৯৯০ সালে মন্দির নির্মাণের জন্য দেশব্যাপী প্রচারণা শুরু করে। তার আগে হিন্দু ও মুসলিম গোষ্ঠীগুলো আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ সমাধানের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল।

বিজেপির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লাল কৃষ্ণ আদভানি একটি ট্রাকে প্রাচীন রথের আদল তৈরি করে দেশ-বিদেশে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তার এই রথযাত্রা হিন্দুদের উন্মাদনা বৃদ্ধি এবং মুসলমানদের সাথে বিভেদকে আরও জটিল করে তোলে। একই সঙ্গে আদভানির এই কর্মসূচি দলটিকে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়ে যায়।

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় আয়োজিত এক সমাবেশে বিজেপির প্রচারাভিযান চরমে পৌঁছায়। ওই দিন একদল উন্মত্ত জনতা বাবরি মসজিদে আরোহণ করেন এবং কুড়াল ও হাতুড়ি দিয়ে মসজিদের গম্বুজগুলো গুঁড়িয়ে দেন। এর ফলে মসজিদের পুরো কাঠামো প্রায় সমান হয়ে যায়।

এই ঘটনাটি ভারতের বিভিন্ন অংশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়। দাঙ্গায় প্রাণ যায় প্রায় ২ হাজার মানুষের; যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান।

হিন্দুপ্রধান ১৪২ কোটি মানুষের দেশ ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ মুসলমান। সেই সময়ে বিজেপির সম্মুখ সারির নেতা হিসেবে নরেন্দ্র মোদি রথযাত্রার আয়োজনে সহায়তা করেছিলেন; যার শুরু হয়েছিল তার নিজ রাজ্য গুজরাটে।

কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদীর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নরেন্দ্র মোদি। তার নির্বাচনী সব প্রতিশ্রুতির অন্যতম ছিল অযোদ্ধায় রাম মন্দিরের নির্মাণ।

সূত্র: রয়টার্স।

এসএস