উত্তর কোরিয়া তাদের পূর্ব উপকূলের দিকে একাধিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে বলে জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনী। গত কয়েক মাস ধরে পারমাণবিক শক্তিধর এই সমাজতান্ত্রিক দেশটি টানা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে যাচ্ছে, যা ওই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

রোববার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয় সিনপো বন্দরের কাছে। তবে ঠিক কতটি এবং কী ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র তা এখনও পরিষ্কার নয়।

এর আগে বুধবার উত্তর কোরিয়া পুলওয়াসাল-৩-৩১ নামের একটি নতুন কৌশলগত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে বলে জানিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার বার্তা সংস্থা ইয়োনহাপ। স্থানীয় সময় রোববার সকাল ৮ টায় নতুন করে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ বলেছেন, ‘‘আমাদের সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, উত্তর কোরিয়ার দিক থেকে আর কোনও প্ররোচনা আসে কি না।’’

সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উন কথা বার্তা ও নীতি নির্ধারণে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন। শান্তি বজায় রাখাসহ সামরিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বেশ কিছু চুক্তিও লঙ্ঘন করেছেন তিনি।

পিয়ংইয়ং দাবি করে আসছে, তারা জানুয়ারি মাসের শুরু থেকেই পুরোপুরি জ্বালানি নির্ভর ক্ষেপণাস্ত্র ও পানির নিচে ড্রোন দিয়ে আক্রমণের সফল পরীক্ষা করে আসছে, যার মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্রও বহন করা সম্ভব হতে পারে।

তারা জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে গত দুই বছর ধরে প্রায় প্রতি মাসে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ও অস্ত্র পরীক্ষা করে আসছে। এই মাসের শুরুর দিকে কিম জং উন ঘোষণা দেন, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে পুনর্মিলনের সমস্ত সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে, তার বর্ণনায় দক্ষিণ কোরিয়াই এখন তাদের প্রধান শত্রু।

তার এমন বক্তব্য উত্তর কোরিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইওন সুক ইয়ুল এ মাসে মন্ত্রিসভায় বলেন, যদি উত্তর থেকে কোনও ধরনের প্ররোচনা আসে তাহলে দক্ষিণ সেটা হাজারগুণ শক্তিতে প্রতিরোধ করবে।

কিছুদিন আগে সাবেক সিআইএ বিশেষজ্ঞ রবার্ট এল কার্লিন ও পরমাণু বিজ্ঞানী সিগফ্রাইড এস হেকার, যিনি বেশ কয়েকবার উত্তর কোরিয়া ভ্রমণ করেছেন, তারা থার্টি এইট নর্থ ওয়েবসাইটে এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, আমাদের বিশ্বাস, ১৯৫০ সালে তার দাদার মতো, কিম জং উনও যুদ্ধের একটা কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এমন মন্তব্য সতর্কতা জারি করলেও বেশিরভাগ বিশ্লেষক, এই ধারণার সাথে একমত নন। এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা মিলিয়ে বিবিসি সাতজন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলেছে, যাদের কেউই এই যুদ্ধের ধারণাকে সমর্থন করেননি।

‘‘নিজেদের পুরো শাসন ব্যবস্থাকে এক বিপর্যয়মূলক সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক উত্তর কোরিয়ার নীতি নয়। তাদের নির্দয় কৌশলী নীতি প্রমাণিত,’’ বলেন নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক ক্রাইসিস গ্রুপের কোরিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক ক্রিস্টোফার গ্রিন।

তিনিসহ অন্য বিশ্লেষকরা মনে করিয়ে দেন, উত্তর কোরিয়া প্রায়ই পশ্চিমাদের আলোচনার টেবিলে আনতে উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক চাপও আছে। কিন্তু তারা এ বিষয়ে একমত যে, কিমের ক্রমশ আক্রমণাত্মক আচরণ এখন আর অগ্রাহ্য করার উপায় নেই এবং তার প্রশাসন দিনদিন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

যদিও বেশিরভাগই কোনও যুদ্ধ শুরু হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত নন। তবে কারও কারও শঙ্কা, সীমিত আকারে হলেও আক্রমণ দেখা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক সেনাবাহিনীর কথা মাথায় রেখে উত্তর কোরিয়া আদৌ কি কোনও আক্রমণে যাবে?

‘‘একটা যুদ্ধ হলে দক্ষিণে হয়তো অনেক মানুষ মারা যাবে, কিন্তু সেটা কিম জং উন ও তার শাসনেরও ইতি ঘটাবে ,’’ বলেন সিউলের কুকমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চার পিটার ওয়ার্ড। তবে এই গবেষকও অন্যদের মতো সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, পরিস্থিতি ছোটখাট সংঘর্ষের দিকে এগোচ্ছে।

কিন্তু কারও কারও মতে কিম জং উন আসলে দেশের অভ্যন্তরে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতেই এসব করছেন। সিউলের এওহা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেইফ এরিক এসলি বলেন, ‘‘উত্তর কোরিয়ানরা এখন সচেতন হয়ে উঠছে যে দক্ষিণের তুলনায় তাদের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে।’’ সেখানে দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষের খবরও আসছে। এই কঠিন সময়ে কাউকে শত্রু হিসেবে সামনে এনে তার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ বাবদ খরচেরও স্বীকৃতি আদায় করা সহজ হয়। বিবিসি বাংলা।

এসএস