ভোট ঘোষণার আগেই পশ্চিমবঙ্গে পুরোদস্তুর প্রচার শুরু করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শুক্র ও শনিবারের জোড়া সভার পর বুধবার ফের প্রচারে রাজ্যে আসবেন তিনি। শুক্রবার হুগলির আরামবাগে সভা করেছিলেন মোদি। সেখানে তিনি তীব্র আক্রমণ করেন তৃণমূল কংগ্রেসকে। সেই ঝাঁজ আরো জোরালো হলো শনিবারের জনসভায়।

শুক্রবারের কর্মসূচি শেষে রাজভবনে ছিলেন ভারতের এই প্রধানমন্ত্রী। আর সকালে হেলিকপ্টারে নদিয়ার কৃষ্ণনগরে পৌঁছান তিনি। প্রথমে ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মোদি। এরপর কাছের মাঠে অন্য একটি মঞ্চে দলীয় জনসভায় যোগ দেন বিজেপির শীর্ষ নেতা।

একের পর এক নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের নারী ভোটাররা তৃণমূলকে বিপুলভাবে সমর্থন করেছেন। এবার নারীদের উদ্দেশে বার্তা দিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। তার বক্তৃতায় জায়গা করে নিচ্ছে সন্দেশখালির সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ।

মোদি বলেন, তৃণমূল এখানে মা, মাটি, মানুষের স্লোগান তুলে ভোট নিয়েছে। কিন্তু সন্দেশখালির বোনেরা কাতর আর্তি করছেন। তৃণমূল সরকার তাদের কথা শোনেনি। এখানে পুলিশ না, দুষ্কৃতি সিদ্ধান্ত নেয় যে কখন তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে। রাজ্য সরকার তো সন্দেশখালির অপরাধীকে ধরতেই চায়নি। তবে বাংলার নারীরা দুর্গা রূপে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।

নারী ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, গোটা দেশে নারী হেল্পলাইন চালু হয়েছে। তবে তৃণমূল সরকার সেটাকে গুরুত্ব দেয় না। কেন্দ্রীয় সরকার ১০ কোটি নারীকে সস্তায় গ্যাস দিচ্ছে। বাংলাতেও ১৩ লাখ আবেদন এসেছে। তবে তারা উজ্জ্বলা কমিটি গঠন করেনি জেলায় জেলায়। ওরা চায়, কে সস্তায় গ্যাস পাবে, সেটা ঠিক করবে তৃণমূলের তোলাবাজ।

কার্যত এবার নারী ভোটের দিকে বিজেপির লক্ষ্য। সে প্রসঙ্গে প্রবীণ সাংবাদিক দেবাশিস দাশগুপ্ত বলেন, কয়েকদিন আগেই চারটি রাজ্যের ভোট হয়ে গেছে। যে সব জায়গায় বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে, সেখানে তারা বিপুল নারী ভোট পেয়েছে। অনেক নারী উন্নয়নমুখী প্রকল্প চালু করেছে তারা। তাই পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির লক্ষ্য নারী ভোট। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের আরামবাগ ও কৃষ্ণনগর; যে দুটি জায়গায় মোদীর জনসভা হয়েছে, একটা বড় অংশের উপস্থিতি নারীদের, এটা লক্ষ্য করা গেছে।

বিভিন্ন ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে আক্রমণ করেন মোদি। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে দুর্নীতি। তিনি বলেন, এই তৃণমূল সরকার প্রতিটি স্কিমকে স্ক্যামে পরিণত করে দেয়। তবে মোদির গ্যারান্টি, আগামী পাঁচ বছর ফ্রি রেশন দেবে। তৃণমূল তাতেও নিজেদের স্টিকার লাগায়। রেশন চুরি করতেও তারা পিছপা হয় না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের পথে বাধা বলে চিহ্নিত করেন মোদি। তিনি বলেন, তৃণমূলের জন্য বাংলায় উন্নয়ন হচ্ছে না। টিএমসি মানে বিশ্বাসঘাতকতা, দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র। তৃণমূল বাংলার মানুষজনকে গরিব করে রাখতে যায়।

বুধবার ৬ মার্চ আবার পশ্চিমবঙ্গে আসবেন মোদি। সেদিন উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসতে তার জনসভা। দেবাশিস দাশগুপ্ত বলেন, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে বিজেপির নজর। এবার যদি দুটি আসন তারা বেশি পায় তাহলে দলকে উজ্জীবিত রাখা যাবে। তাই পশ্চিমবঙ্গ এত গুরুত্ব পাচ্ছে। এই রাজ্য থেকে লোকসভা নির্বাচনের প্রচার শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী।

তৃণমূলকে অপশাসনের অভিযোগে বিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি উন্নয়নকে প্রচারের হাতিয়ার করতে চাইছে। শুক্র ও শনিবার একগুচ্ছ সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গকে উন্নত রাজ্যে পরিণত করার জন্য আমরা আরও একটি পদক্ষেপ নিলাম। আজ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সুযোগ পাওয়া গেল। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে যুব সমাজের কাছে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।

তৃণমূলের সমালোচনার পাশাপাশি উন্নয়নের কাজকে তুলে ধরছে বিজেপি। আগামী ১০০ দিন সেই বার্তা রাজ্যের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেয়ার ডাক দিয়েছেন বিজেপি। দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ৩৫টিতে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিলেন। কৃষ্ণনগরে মোদি বললেন, তিনি ৪২টি আসনেই দলের প্রার্থীদের জয় চাইছেন।

এদিনের জনসভার পর মোদি বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে মিনিট ২০ বৈঠক করেন। সুকান্ত জনিয়েছেন, তারা প্রধানমন্ত্রীকে পশ্চিমবঙ্গের চলতি পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন।

তৃণমূল মুখপাত্র শান্তনু সেন বলেন, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতারা বারবার এ রাজ্যে এসেছেন। ফল কী হয়েছে সবাই জানে। এবারও ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে লাভ হবে না। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের মানুষ বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করবে।

সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির কথা বলছেন। কিন্তু দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালদের ক্ষেত্রে হাত গুটিয়ে বসে আছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। এতেই পরিষ্কার, তৃণমূল ও বিজেপি একে অপরের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্রের মতে, বিজেপি যদি মনে করে, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম বা কংগ্রেস তাদের যত বড় শত্রু, তৃণমূল তার তুলনায় কম শত্রু, তাহলে বিজেপি নিজে কটা আসন পাবে, এর সঙ্গে তারা গুরুত্ব দেবে, তৃণমূল কটা আসন পেতে পারে। কারণ তৃণমূল তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু নয়। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে, মোদি যদি ভাবেন, বিজেপি ও তৃণমূল কত আসন পাবে, সেদিক থেকে ৪২ আসনের ভাবনা অসম্ভব নয়।

এসএস