মহামারি করোনার প্রকোপে বিপর্যস্ত ভারত। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ আক্রান্তের বিশ্বরেকর্ড হয়েছে। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে সর্বাধিক ২ হাজার ৬২৪ জনের। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে দৈনিক মৃত্যু ৫ হাজার ৬০০ হতে পারে বলে পূর্বাভাস মিলেছে এক গবেষণায়।

ভাইরাসটির দ্বিতীয় দফা প্রকোপ চলছে ভারতে। এখন দৈনিক আড়াই সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হলেও আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সেটা পাঁচ হাজার ছাড়ালে ১২ এপ্রিল থেকে ১ আগস্টের মধ্যে ভারতের করোনায় মৃত্যু হতে পারে আরও প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার মানুষের।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন’র (আইএইচএমই) সাম্প্রতিক গবেষণায় ভারতে করোনা মহামারির পূর্বাভাস নিয়ে উদ্বেগজনক এমন পরিসংখ্যানই তুলে ধরা হয়েছে।

প্রায় একই রকমের ইঙ্গিত মিলেছে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায়। তাতে বলা হয়েছে, মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতে দৈনিক মৃত্যু সাড়ে ৪ হাজার ছাড়াতে পারে। আর জুলাইয়ের শেষদিকে সক্রিয় রোগীর সংখ্যা বাড়বে আরও ৮ থেকে ১০ লাখ।

সারি সারি চিতা জ্বলছে দিনরাত

শনিবারের এক অনলাইন প্রতিবেদনে ভারতের করোনা পরিস্থিতির উদ্বেগজনক অবনতির এই খবর জানিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। তবে বাংলা দৈনিকটি লিখেছে, কলকাতার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের এই গবেষণা দুটির সঙ্গে পুরোপুরি একমত হননি। 

তাদের বক্তব্য, মানুষ বাইরে বের হলে মাস্ক পরবেন না, শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে চলবেন না, বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে ‘স্যানিটাইজ’ করবেন না, কোভিড টিকা তেমনভাবে দেওয়াই হবে না— এমন কয়েকটি পূর্ব ধারণার (অ্যাসাম্পশন) ভিত্তিতেই এই পূর্বাভাস।

কলকাতার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অথচ গত এক সপ্তাহে পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। মানুষ মাস্ক পরে রাস্তায় বের হচ্ছেন। টিকা দেওয়ার কাজও চলছে। ফলে পূর্বাভাস দুটি মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে পরিস্থিতিতে যে সঙ্কটজনক, তা তারা মেনে নিচ্ছেন।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইএইচএমই’র ‘কোভিড-১৯ প্রোজেকশনস ইন ইন্ডিয়া-২০২১’ শীর্ষক গবেষণাপত্রের দাবি, এপ্রিলের মাঝামাঝি ভারতে সবচেয়ে বেশি মানুষের রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পঞ্চম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মহামারি করোনাভাইরাস।

গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ১২ এপ্রিল থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত ভারতে কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গ আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে চলেছে। এতে করে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই দৈনিক মৃত্যু সাড়ে হবে ৫ হাজারের বেশি। ভয়ঙ্কর ভাবে বাড়বে সংক্রমণের হারও।

তার ফলে আগামী ১২ এপ্রিল থেকে ১ আগস্টের মধ্যে ভারতে করোনায় মৃতের সংখ্যা আরও প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার বাড়বে। যার পরিণতিতে জুলাইয়ের শেষদিকে গিয়ে ভারতে মহামারি করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬ লাখ ৬৫ হাজারের কিছু বেশি।

তবে মানুষ যদি মাস্ক পরার ব্যাপারে চোখে পড়ার মতো আগ্রহী হয়ে ওঠেন, টিকাদান কর্মসূচির প্রক্রিয়া যদি স্বাভাবিক থাকে, তাহলে করোনায় মৃতের সংখ্যা পূর্বাভাসের চেয়ে ৭০ হাজার কমে যেতে পারে বলেও ওয়াশিটংন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় জানানো হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, মাস্ক না পরা, শারীরিক দূরত্ববিধিগুলো না মেনে চলার খেসারত গুনতে গিয়ে এপ্রিলের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে গোটা ভারতে নতুন করে করোনা সংক্রমণের ঘটনা বেড়েছে ৭১ শতাংশ। আর দৈনিক কোভিড-মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ৫৫ শতাংশ।

কলকাতার জিন বিশেষজ্ঞ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ন্যাশনাল সায়েন্স চেয়ার’ পার্থপ্রতিম মজুমদার অবশ্য দুটি গবেষণার ফলাফল ও পূর্বাভাস মেনে নিতে রাজি হননি। একই অভিমত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামীরও।

তারা বলছেন, গবেষকরা এটা জানেন যে, পূর্বধারণার ভিত্তিতে নানা ধরনের মডেলের ওপর নির্ভর করে এসব গবেষণা চালানো হয়ে থাকে। প্রকোপ বাড়তে থাকায় তা দ্রুত বদলাতে থাকে। কারণ মানুষ তো আগে বাঁচতে চান। ফলে তারা নিজেরাই সতর্ক হয়ে যান।

পার্থপ্রতিম বলেন, ‘গত এক সপ্তাহেই দেখছি মানুষের সচেতনতা কিছুটা বেড়ে গেছে। মানুষ নিজে থেকেই মাস্ক পরতে শুরু করেছে। শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে চলার চেষ্টা করছেন তারা। সরকার স্বাভাবিকভাবে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এছাড়া টিকাদান কর্মসূচির গতিও মন্দ নয়। ফলে দুটি গবেষণার পূর্বাভাস পুরোটা মিলে যাবে, এমনটা অন্তত আমার মনে হয় না।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী জানাচ্ছেন, প্রথম তরঙ্গ শুরু হওয়ার পর মানুষের সচেতনতা গড়ে তুলতে পুলিশ প্রশাসনকে যতটা ঘাম ঝরাতে হয়েছিল, এবার তার প্রয়োজন পড়ছে না। মানুষ কিছুটা সচেতন হয়েছেন। কারণ কী কী করতে হবে তা জেনে গেছেন। তবে বর্তমানে কোভিড পরিস্থি্তি যে খুব উদ্বেগজনক, তা মানছেন তারা।

পার্থপ্রতিম বলছেন, ‘ভোটের ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ঢল নামবে রাস্তায়। এছাড়া জনসমাবেশের সংখ্যা বাড়বে। তাতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। এ ব্যাপারেও মানুষকে সচেতন থাকার জন্য অনুরোধ করছি।’

এএস