সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) বোমা হামলার জবাব দিতে গত শনি ও রোববার ইসরায়েলে যে ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তেহরান, তা চিন্তিত করে তুলেছে ইসরায়েল ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের।

কারণ সাম্প্রতিক হামলা-পাল্টা হামলার পর উত্তেজনা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকছে পরস্পরের প্রতি চরম বৈরীভাবাপন্ন দুই দেশের শাসকগোষ্ঠী। আইডিএফ যদিও বলেছে, ইরানে পাল্টা হামলার মাধ্যমে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়া হবে, কিন্তু কবে হামলা চালানো হবে— সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলেনি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। অন্যদিকে তেহরান বলেছে, যদি আইডিএফ পাল্টা আঘাত করে— তাহলে ব্যাপক বিধ্বংসী হামলার মাধ্যমে তার জবাব দেবে ইরানের সামরিক বাহিনী।

প্রসঙ্গত, ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের সঙ্গে চরম দ্বন্দ্ব রয়েছে ইরানের। সেই দ্বন্দ্ব আরও ব্যাপকভাবে বেড়েছে গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে।

চলমান এই বৈরীতার মধ্যেই গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে বোমা হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। এতে নিহত হন ১৩ জন। নিহতদের মধ্যে ইরানের সামরিক বাহিনীর এলিট শাখা ইসলামিক রেভোল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) দুই জ্যেষ্ঠ কমান্ডার মোহাম্মদ রেজা জাহেদী এবং মোহাম্মদ হাদি হাজি রাহিমিও ছিলেন।

হামলার দায় এখন পর্যন্ত ইসরায়েল স্বীকার করেনি। তবে সাক্ষ্য-প্রমাণ যা পাওয়া গেছে,তাতে হামলাটি যে আইডিএফ করেছিল— তা পরিষ্কার।

গত সপ্তাহে ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছিলেন— এই হামলার জন্য ইসরায়েলকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।

তারপর শনিবার রাত ও রোববার ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ৩ শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরানের সামরিক বাহিনী। হামলায় হতাহতের কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগ ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার আগেই ধ্বংস করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। তবে ইসরায়েলের ৯টি স্থাপনায় ইরানি ড্রোন আঘাত হানতে সফল হয়েছে বলে জানা গেছে।

গত ১৩-১৪ এপ্রিল যে শুধু ইরানের সেনাবাহিনীই হামলা চালিয়েছিল— এমন নয়। লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুথি— ইরানের মদতপুষ্ট দুই রাজনৈতিক গোষ্ঠীও ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে। আইডিএফের তথ্য অনুযায়ী, গত শনি ও রোববার ইসরায়েলের গোলানের সেনা ঘাঁটি লক্ষ্য করে অন্তত ১৫০টি রকেট ছুড়েছে হিজবুল্লাহ। একই সময়ে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ড্রোন ছুড়েছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরাও।

হিজবুল্লাহর হামলার জবাবে সোমবার লেবাননের মেইস এল জাবাল এবং তায়ের হারফা এলাকায় গোষ্ঠীটির সামরিক ঘাঁটিতে ১৫ এপ্রিল সোমবার হামলা করেছে ইসরায়েলের বিমান বাহিনী। তবে কোনো হামলাতেই প্রাণহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি।

এদিকে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের কেন্দ্রীয় যে ইস্যু— সেই গাজা উপত্যকায় রোববার থেকে অভিযান সীমিত করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজা থেকে নিজেদের সেনাদের অধিকাংশই প্রত্যাহার করে নিয়েছে আইডিএফ। ইসরায়েলি সেনাদের মাত্র একটি ডিভিশন বর্তমানে গাজায় অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।

গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে দক্ষিণ ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে নিয়মিত রকেট-ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে হিজবুল্লাহ। গত ছয় মাসে গোষ্ঠীটি প্রায় ৩ হাজার ১০০ রকেট-ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে।

তবে গত ১৫ এপ্রিল সোমবার থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে কোনো বিস্ফোরক নিক্ষেপ করেনি হিজবুল্লাহ।

কিন্তু হামলার পর এই যে স্থিতাবস্থা, তাতে স্বস্তির তেমন জোরালো কোনো কারণ দেখছেন না মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। কারণ, গাজা থেকে অধিকাংশ সেনাকে প্রত্যাহার করে নিলেও সেখানে অভিযান বন্ধের কোনো ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত দেয়নি ইসরায়েল বা আইডিএফ। অন্যদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত যে প্রস্তাব এই যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী তিন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর দিয়েছে, তাতে এখনও সম্মতি দেয়নি হামাস।

ইসরায়েলি রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ১৩-১৪ এপ্রিল ইরানের হামলার মধ্যে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে, যে অধ্যায় শুরু হয়েছিল গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলা এবং তার জবাবে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরুর মধ্যে দিয়ে।

বিশ্লেষকদের মতে, তেহরান-হামাস-হুথিদের এই নীরবতা আসলে শান্তির আগমনীবার্তা নয়, বরং ঝড়ের আগের স্থিতাবস্থা। বড় ঝড় ওঠার আগে প্রকৃতিতে যেন খুব শান্ত ভাব দেখা দেয়— এখনকার অবস্থাও তেমনি।

তারা বলেছেন, ইসরায়েলি বাহিনীর উচিত হবে এই শান্ত অবস্থায় আশাবাদী না হয়ে পরবর্তী বড় হামলা ঠেকানোর জন্য জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখা।

সূত্র : জেরুজালেম পোস্ট

এসএমডব্লিউ