দুবাইয়ের শাসক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া শেখ মোহাম্মদ আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে দুবাই পুলিশের প্রধানের পদে ছিলেন। শেখ রাশেদ বিন সাইদ আল মাকতুমের তৃতীয় পুত্র তিনি। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতির কেন্দ্রে থাকা আমিরাতের ভাইস-প্রেসিডেন্টও এই শেখ মোহাম্মদ, সঙ্গে দুবাইয়ের শাসকও তিনি। তার বর্তমান ও সাবেক মিলে ছয় জন স্ত্রী রয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এ ছয় স্ত্রীর ঘরে তার রয়েছে ৩০ জন সন্তান। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ ধনকুবের এই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিজীবনের নানা দিক উঠে এসেছে তার নিজের লেখা  ‘কিস্সাতি’ (আমার গল্প) বইটিতে। পঞ্চাশ পর্বে সে গ্রন্থ থেকেই নানা দিক তুলে এনেছেন মুহাম্মাদ শোয়াইব। আজ থাকছে সপ্তম পর্ব। 


যেকোনো সন্তানের চাওয়ার মতো আমিও দাবি করি আমিই আমার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান ছিলাম। আসলে মায়ের ভালোবাসাটাই এমন যে, প্রত্যেক সন্তান মনে সেই তার মায়ের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার। 

আমি যখন একটু বড় হলাম তখন আমি নানাভাবে মাকে খুশি করার চেষ্টা শুরু করি। কোথাও কোনো সফরে গেলে ফেরার সময় আমি মায়ের জন্য উপহার নিয়ে আসতাম। সে খুশি হলে আমিও খুশি হতাম। তার মুখের হাসি আমার সারাটা দিন আলোকিত করে দিত। 

যে মানুষ আসলে মায়ের ভালোবাসা পায়নি সে জীবনের স্বাদই পায়নি। মায়ের ভালোলাগায় সন্তানের যেমন ভালো লাগে, তেমনি মায়ের ক্লান্তি আমাদের কষ্ট দেয়, তার দুঃখ আমাদের ভেঙে দেয়, তার অসুস্থতা আমাদের ক্লান্ত করে। 

মাকে হারানোর মুহূর্তটা ভয়াবহ এক ব্যথার, অসীম এক শূন্যতার। ১৯৮৩ সালের মে মাসে আমি আমার মাকে হারাই। আমি আমার হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা হারাই। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তিটা হারাই, আর আমার বাবা হারান তার জীবনের চল্লিশ বছরেরও বেশি সময়ের জীবনসঙ্গিনী। 

আমার মা কখনও চাইতেন না অন্য কেউ বাবার জন্য সকালের নাস্তা তৈরি করুক। বাবা ভোরে বিভিন্ন প্রকল্প দেখার জন্য বেরিয়ে পড়তেন। সব দেখার পর আবার বাড়ি ফিরে আসতেন আমার মায়ের সঙ্গে এক সাথে নাস্তা করতে।  

লম্বা সময় অসুস্থ থাকার পর মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগে বাবা মাত্র সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই ধাক্কা তাকে আবার নতুন করে অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়। সারা জীবন আমার বাবা ছিলেন শক্ত, গম্ভীর একজন মানুষ। তিনি আমাদের সামনে মাথা নোয়াবার মানুষ নন। কিন্তু আমার মায়ের মৃত্যুর পর তার জীবন আর আগের মতো ছিল না।

মায়ের মৃত্যুর পর আমি বাবাকে নিয়ে খুব ভয় পেতাম। বাবা এত বড় আঘাত  পেয়েছিলেন যে আমরা তাকে কখনও একা ছাড়তাম না। বাবার মতোই আঘাত পেয়েছিলেন দুবাইয়ের অধিবাসীরাও। দুবাইয়ের লোকেরা হারিয়েছিলেন তাদের মা শেখ লতিফা বিনতে হামদানকে, যিনি তাদের হৃদয় থেকে ভালোবাসতেন, তারাও তাকে ভালোবাসতো। 

আমার মা অসুস্থদের চিকিৎসা করাতেন, দুস্থ-দরিদ্রদের কথা শুনতেন, নারীদের না বলা কথাগুলোও শুনতেন, সবার সাথে আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নিতেন।  

কে হতে পারে আমার মায়ের মতো? কে হতে পারে শেখ লতিফার মতো?

আমার মনে আছে, রাতে আমাকে খুঁজতেন মা, দেখতে যেতেন আমি আমার প্রিয় ঘোড়া উম্ম হাল্লাজের আস্তাবলে ঘুমিয়ে পড়েছি কি-না। মায়ের সঙ্গে আমাদের আনন্দের সময়গুলো এখনও মনে পড়ে। 

ষষ্ঠ পর্ব : মায়ের সঙ্গে কিছু স্মৃতি

আমার মনে পড়ে, মা যখন সকালে নাস্তা তৈরি করতেন আমি তার পাশে বসে তার সঙ্গে কথা বলতাম। আমার এখনও মনে আছে, ছোটবেলায় মা আমাকে ছোট্ট কিছু নোটবুক দিয়ে বলেছিলেন, আমি যেন তাতে আমার ঘোড়া, মরুভূমি ও বিভিন্ন প্রাণী সম্পর্কে কিছু লিখি। আমি এখনও ওই নোটবুকের গন্ধ পাই। আমার মুখে এখনও তার বানানো রুটির স্বাদ লেগে আছে।  

কে হতে পারে আমার মায়ের মতো? কে হতে পারে শেখ লতিফার মতো?

আমার এখনও মনে পড়ে সেই মুহূর্তের কথা, যখন আমার মা চিকিৎসা করানোর জন্য ইংল্যান্ড যাচ্ছিলেন। যাওয়ার আগে আমি তাকে চুমু খাই। তাকে ছুঁয়ে দেখি। তার শরীরের সঙ্গে নিজেকে লেপ্টে রাখি। আমি তাকে জড়িয়ে ধরি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আমার কমনীয়তার প্রশংসা করেন। 

আমি ভেবে রেখেছিলাম মা চিকিৎসা শেষে ফিরে এলে আমি তাকে আমার ঘড়িটি উপহার দেবো। কারণ, ঘড়িটি তার খুব পছন্দের ছিল।   

আমার ঘড়িটি তার খুব পছন্দের। তারপরে তিনি চলে যান। আমার ইচ্ছা ছিল, চিকিৎসা শেষে তিনি ফিরে এলে আমি তাকে উপহার দেবো। কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেননি। আমার মা আর ফিরে এলেন না। আমার ঘড়িটি আমার হাতেই থাকল। 

মায়ের জানাজায় হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। জানাজায় দাঁড়িয়ে দুবাইয়ের হাজার হাজার মানুষ মায়ের জন্য কেঁদেছিলেন। মাকে কবর দেওয়ার সময় কিছুতেই আমি কান্না থামাতে পারছিলাম না। মাকে যখন আমি কবরের মাটিতে শুইয়ে দিচ্ছিলাম আমার হাতে থাকা ঘড়িটি হাত থেকে খুলে পড়ে গেল ঠিক তার নিথর দেহের পাশে। এ দৃশ্য দেখে আমি সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। আমি একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছিলাম, আরেকবার ঘড়িটার দিকে। 

মা চলে যাওয়ার পর আমাদের বাড়িটিই অন্যরকম হয়ে যায়, আর আমাদের জীবন বদলে যায়। পরিচিত রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, চেনাপরিচিত মুখ সবই বদলে যায়। 
মায়ের মৃত্যুর পর বাবা বেশ ধৈর্যশীল ছিলেন। কয়েক দিন পরে তিনি যখন মায়ের অসিয়ত লিখতে বসলেন সেদিন ঘটল অভূতপূর্ব এক ঘটনা। অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করলেন বাবা। সাহসী, জেদি বলে পরিচিত মানুষটাকে এভাবে কেউ কাঁদতে দেখেনি আগে। কেউ কখনো কল্পনাও করেনি বাবাকে এভাবে দেখার কথা। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বারবারই বলছিলেন মরহুমার অসিয়ত, মরহুমার অসিয়ত, মরহুমার অসিয়ত। কিন্তু অসিয়তের কথাগুলো তিনি কান্নার কারণে বলতে পারছিলেন না।

এনএফ