ভারতে হিন্দু মন্দিরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিতর্ক
তামিলনাডুর একটি মন্দিরের সামনে ভক্তসমাগম
দক্ষিণ ভারতের রাজ্য তামিলনাডুতে হিন্দু মন্দিরগুলোর নিয়ন্ত্রণ সরকার না বেসরকারি ট্রাস্ট — কাদের হাতে থাকবে, তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। রাজ্য সরকারের হাত থেকে মন্দিরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিতে সম্প্রতি সেখানে ‘ফ্রি টেম্পল’ নামে একটি আন্দোলন শুরু করেছেন ধর্মীয় নেতা জাগগি বাসুদেব। তিনি তার অনুসারীদের কাছে ‘সদগুরু’ নামে পরিচিত।
তবে রাজ্যে নবনির্বাচিত ডিএমকে সরকার এই দাবির কড়া বিরোধিতা করেছে। তামিলনাডুর নতুন অর্থমন্ত্রী এমনও অভিযোগ করছেন যে— মন্দিরগুলো থেকে বাড়তি অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যেই সেগুলোর কর্তৃত্ব দখলের চেষ্টা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু তামিলনাডুর সমাজে এই বিতর্ক কীভাবে আর কেন সাড়া ফেলেছে?
বস্তুত ভারতে হিন্দু মন্দিরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি যে রাজ্যে, সেটি নিশ্চিতভাবেই তামিলনাডু। রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মন্দিরের অনেকগুলোই অত্যন্ত সম্পদশালী, তার কোনো কোনোটিতে শত শত কোটি টাকার স্বর্ণ ও ভক্তদের দানের অর্থও রয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে পাস হওয়া একটি আইনের সূত্র ধরে এই মন্দিরগুলোর প্রায় সবই নিয়ন্ত্রণ করে রাজ্য সরকার, যে আইনটির আধুনিক সংস্করণের নাম ‘হিন্দু রিলিজিয়াস অ্যান্ড চ্যারিটেবল এনডাওমেন্টস অ্যাক্ট’। কিন্তু এই আইন বাতিল করে হিন্দু মন্দিরগুলো ‘মুক্ত’ করার লক্ষ্যে কয়েকমাস আগে একটি অভিযান শুরু করেন সেখানকার আধ্যাত্মিক গুরু ও ইশা ফাউন্ডেশনের কর্ণধার জাগগি বাসুদেব তথা সদগুরু।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলছেন, ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদের মন্দিরগুলোর ধনসম্পত্তির লোভে যে দখল নিয়েছিল, সেই দস্যুবৃত্তি দুর্ভাগ্যবশত আজও অব্যাহত। মনে রাখতে হবে, আগে আমাদের মন্দিরগুলো তৈরি হয়েছে - তারপর তাকে ঘিরে নগর, যে জন্য আমরা বলি ‘টেম্পল টাউন’।’
জাগগি বাসুদেব বলেন, ‘ভক্তির ধারা যে সংস্কৃতিতে এত গভীরভাবে প্রোথিত, সেখানে সরকারের তত্ত্বাবধানে আমাদের মন্দিরগুলো ভেঙে পড়ছে, তারা মন্দিরগুলোকে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলছে।’
গত বছরের জুলাইতে মাদ্রাজ হাইকোর্টে সরকারের দেওয়া একটি হলফনামা উদ্ধৃত করে তিনি আরও যুক্তি দিচ্ছেন, রাজ্যের প্রায় ১২ হাজার মন্দিরে দৈনিক একবার পুজো দেওয়ার মতো ক্ষমতা বা সঙ্গতিও যে তাদের নেই — তামিলনাডু প্রশাসন তা নিজেরাই স্বীকার করেছে।
কিন্তু রাজ্যের নতুন অর্থমন্ত্রী ও সাবেক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার পি থিয়াগা রাজন জাগগি বাসুদেবের এই আন্দোলনকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছেন। মিডিয়াতে একের পর এক সাক্ষাৎকার দিয়ে তিনি বলছেন, যে ইশা ফাউন্ডেশন নিজেরাই ধর্মের নামে ব্যবসা করে থাকে, তারা আসলে মন্দিরগুলো কবজা করে আরও পয়সা উপার্জনের রাস্তা খুঁজছে।
বার্তাসংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পি থিয়াগারাজন বলেন, ‘রাজ্যের শাসক দল ডিএমকে-কে যতই হিন্দুবিরোধী, ধর্মবিরোধী বা আস্তিক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হোক, বাস্তবতা তা নয়। আসল কথা হলো, সরকারি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তামিলনাডুতে ধর্মের গণতন্ত্রায়ন হয়েছে — এখানে যে কেউ মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হতে পারেন, নারীরা ও দলিতরাও বোর্ডে থাকতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে কোনো জাতের লোক পুরোহিত হতে পারেন, সংস্কৃতর পাশাপাশি তামিলেও মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারেন। ধর্মের দরজা সবার জন্য খুলে দিয়েই কিন্তু তামিলনাড়ু কোটি কোটি লোককে মন্দিরের ছত্রছায়ায় নিয়ে এসেছে।’
হিন্দু মন্দিরগুলো কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেটা যে তামিলনাডুতে স্পর্শকাতর একটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইস্যু হয়ে উঠছে তা স্বীকার করেন বিবিসি তামিল বিভাগের সাংবাদিক কৃথিকা কাননও।
তিনি বলছিলেন, ‘সদগুরু যখন এই আন্দোলন শুরু করেন তিনি রাজ্যের দুটি প্রধান দল ডিএমকে ও এডিএমকে, উভয়কেই অনুরোধ করেছিলেন তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ফ্রি টেম্পল’-কে সমর্থন করতে।’
‘কিন্তু দুটি দলই কিন্তু সে অনুরোধ এড়িয়ে গেছে। আসলে তামিলনাড়ুতে একটা আশঙ্কা আছে, মন্দিরগুলোর কর্তৃত্ব বেসরকারি ট্রাস্টের হাতে গেলে তারা তাদের ইচ্ছেমতো রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার জন্য সেই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহৃত হতে দেবে। তামিলনাড়ুর কোনো মন্দিরেও এখন কোনো দল সেরকম কিছু করতে গেলে কিন্তু বাধা আসবে — তুমি এখানে পুজো, জপতপ, বিয়ে ইত্যাদি করতে পারো, অন্য কিছু করা চলবে না।’
আসলে তামিলনাড়ুর শহরে-গ্রামে প্রতি পাড়ায় পাড়ায় রয়েছে অজস্র হিন্দু মন্দির, যেগুলো মহল্লার সামাজিক কর্মকাণ্ডেরও কেন্দ্রবিন্দু। এর অনেকগুলো বেশ ধনী, অনেকগুলো আবার কোনোক্রমে চলে।
এখন সেই মন্দিরগুলো পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে থাকা উচিত ও কারা বেশি ভালোভাবে সামলাতে পারবে, সেই বিতর্কে তামিল জনমত ক্রমশ বিভক্ত হচ্ছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিএম