বিশ্বজুড়ে তাণ্ডব চালানো করোনাভাইরাস মহামারির মাঝে নতুন আতঙ্ক হিসেবে হাজির হয়েছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় করোনা রোগীদের সুস্থ হয়ে ওঠার পর সংক্রমণজনিত এই রোগকে বলা হয় মিউকরমাইকোসিস। প্রতিবেশি ভারতের অন্তত তিনটি রাজ্যে করোনার পাশাপাশি এই রোগকে ইতোমধ্যে মহামারি ঘোষণা করা হয়েছে।

বাংলাদেশেও শনাক্ত হয়েছে প্রাণঘাতী এই ছত্রাকের সংক্রমণ। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের উপসর্গ নিয়ে রাজধানী ঢাকার বারডেম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজন মারা গেছেন। মঙ্গলবার (২৫ মে) বারডেম হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম দেলোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

মাইকরমাইসিটিস গোত্রের কয়েকটি ছত্রাক প্রজাতি থেকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। শরীর দুর্বল এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এই ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে। এর পাশাপাশি আরও বিভিন্ন কারণে এই ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটতে পারে। কিন্তু নতুন করে যে চিন্তা দেখা দিয়েছে, সেটি হলো— করোনা রোগীদের শরীরে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ প্রবল হয়ে উঠছে। বিশেষত যে রোগীদের স্টেরয়েড দিতে হচ্ছে বা যারা আগে থেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তারা দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছেন। এছাড়া যে রোগীদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি ও স্টেরয়েড থেরাপি নিয়েছেন তাদেরও মিউকরমাইকোসিসের সংক্রমণ ঘটছে। 

দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেসের (এইমস) পরিচালক ড. রণদীপ গুলেরিয়া বলেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ঠেকাতে হলে প্রাথমিকভাবে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে— ১. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ২. রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা ৩. স্টেরয়েড বা কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের সঠিক ব্যবহার।

তবে করোনা থেরাপিতে স্টেরয়েডের ব্যবহার নিয়ে বার বার সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন প্রশ্ন হল, এই স্টেরয়েড কী? করোনা রোগীদের চিকিৎসায় কেন লাগে? ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণের সঙ্গে স্টেরয়েডের কী সম্পর্ক?
 
করোনা চিকিৎসায় স্টেরয়েড কেন লাগছে?

স্টেরয়েড হলো মানুষের তৈরি একধরনের রাসায়নিক— যা হরমোনের মতো কাজ করে। কৃত্রিম উপায়ে যে স্টেরয়েড তৈরি হয় তাকে সিন্থেটিক স্টেরয়েড বলে। এর আরেক নাম কর্টিকোস্টেরয়েড। প্রদাহজনিত যে কোনও রোগের চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়। অটো-ইমিউন ডিজিজ যেমন আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায়ও স্টেরয়েডের ব্যবহার হয়। রক্তে প্রদাহ, পেশিতে প্রদাহের চিকিৎসাতেও স্টেরয়েডের থেরাপি দেওয়া হয়।
 
সাধারণত মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত সীমিত থাকে। যদি বাইরে থেকে কোনও ভাইরাস বা পরজীবীর সংক্রমণ হয় তাহলে শরীর এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধে সাড়া দেয় ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই সক্রিয়তারও নির্দিষ্ট সীমা আছে। যদি দেখা যায়, রোগ প্রতিরোধ ব্যব্যস্থা অতি-সক্রিয় হয়ে উঠেছে; তখনই প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন শুরু হয়।

সংক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে উল্টো শরীরের সুস্থ কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রেও রোগীর শরীরে একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। অতিসক্রিয় ইমিউন সিস্টেমের কারণে সাইটোকাইন স্টর্ম দেখা দিচ্ছে। এই অতিসক্রিয়তাকে নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য স্টেরয়েডের ব্যবহার করছেন চিকিৎসকরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা কী বলছে

স্টেরয়েড বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে— ট্যাবলেট, সিরাম, ইনজেকশন, ক্রিম ইত্যাদি। রোগীর শারীরিক অবস্থা বুঝে স্টেরয়েডের থেরাপি ব্যবহার করেন চিকিৎসকরা। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের স্টেরয়েড দেওয়ার নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা রোগীর শরীরে যদি টানা ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত প্রদাহ অত্যন্ত বেশি হয় তখন স্টেরয়েড দিতে হয়। তবে তা ২ মিলিগ্রাম/কেজির বেশি নয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনায় বলা হয়েছে, করোনা রোগীদের ডেক্সামিথাসোন, হাইড্রকর্টিসোন ও প্রেডনিসোন জাতীয় স্টেরয়েড মুখে খাওয়ানো বা শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীকে সাত থেকে দশ দিন একবার করে স্টেরয়েড দেওয়া যেতে পারে।

ডেক্সামিথাসোন ডোজ ৬ মিলিগ্রাম, ডাইড্রকর্টিকোসোন ৫০ মিলিগ্রাম, প্রেডনিসোন ৪০ মিলিগ্রামের বেশি দেওয়া যাবে না। রোগীর বয়স এবং ওজন বিচার করেই নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে স্টেরয়েডের ডোজ দিতে হবে। রোগীর ওজন যদি ৬০ কেজি হয়, তাহলে ১২০ মিলিগ্রামের কম স্টেরয়েড দিতে হবে। প্রতিদিনের ডোজ যেন ৬০ মিলিগ্রামের বেশি না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এর বেশি হলেই নানা রকম জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

স্টেরয়েডে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী এবং কেন মিউকরমাইকোসিস সংক্রমণ
 
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টেরয়েডের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে নানা রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমন— বদহজম, বুক জ্বালাপোড়া, ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া, স্থুলতা বৃদ্ধি, ঘুম কমে যাওয়া বা স্লিপিং ডিসঅর্ডার, মানসিক অস্থিরতাসহ শরীরে নানা ধরনের অস্বস্তি। এছাড়া ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক বা পরজীবীর সংক্রমণের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। গুটি বসন্ত, হামও দেখা দিতে পারে। রক্তে শর্করার পরিমাণ, অস্টিওপোরোসিস, গ্লুকোমার ঝুঁকি বাড়তে পারে।

চিকিৎসকরা বলছেন, স্টেরয়েডের অতিরিক্ত ব্যবহার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ দেখা দেয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় স্টেরয়েডের ব্যবহারে রক্তে শর্করার পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।

রক্তে সুগার লেভেল ১০০ বা ১১০ এর চেয়ে বেশি হলে সেটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৪০ ছাড়িয়ে গেলে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া ডায়াবেটিস রয়েছে এমন করোনা রোগী যাদের স্টেরয়েড দেওয়া হচ্ছে তাদের ডোজ বেশি হয়ে গেলে বিপদ। কারণ এই রোগীদের ক্ষেত্রে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বেশি ঘটছে। আর এই ছত্রাকে ফুসফুস, চোখ, কিডনি ও মস্তিষ্ক আক্রান্ত হচ্ছে। সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে এখন পর্যন্ত ৯ হাজারের বেশি মানুষ ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত হয়েছেন। দেশটির অন্তত ২২টি রাজ্যে এই ছত্রাক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগে মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশেরও বেশি।

সূত্র: দ্য ওয়াল, টাইমস অব ইন্ডিয়া।

এসএস