মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় পর সৌদি আরবে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছে কাতার। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে কাতারের সঙ্কটের অবসান এই সম্মেলন থেকে ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সোমবার স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথের অবরোধ তুলে নিয়ে উন্মুক্ত করে দিয়েছে সৌদি আরব। একই পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিয়েছে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নকারী আরেক দেশ মিসরও।

২০১৭ সালের জুনে সন্ত্রাসবাদে সমর্থন, সহায়তা ও ইরান ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ এনে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে অবরোধ আরোপের ঘোষণা দেয় সৌদি নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর। পরে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের আরও একাধিক দেশ কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। যদিও শুরু থেকে সৌদি নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে কাতার।

জিসিসির সম্মেলনে যোগ দিতে মঙ্গলবার সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি পৌঁছালে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। 

কাতারের সঙ্গে স্থল সীমান্ত এবং আকাশপথ সৌদি আরব খুলে দেয়ায় ছয় সদস্য দেশের উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের ৪১তম বার্ষিক সম্মেলন থেকে প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের অবসান ঘটে এই অঞ্চলে নতুন একটি অধ্যায়ের যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

সৌদি আরবের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় আল-উলা শহরে মঙ্গলবার জিসিসির এই সম্মেলন শুরু হচ্ছে। সম্মেলন ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে পুনর্মিলনের আবহ তৈরি হয়েছে; যার নেতৃত্বে রয়েছে রিয়াদ। এই সঙ্কটের সমাধানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আসা কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় অন্যান্য দেশও একই পথে হাঁটতে পারে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন বছরের বেশি সময়ের অবরোধে তৈরি হওয়া অচলাবস্থা কাতার অনেকাংশে সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। তবে সৌদি আরব সোমবার অবরোধ তুলে নেয়ার যে ইঙ্গিত দিয়েছে তাতে আশার আলো দেখছে কাতার। 

পঞ্চম দশকে প্রবেশ করে ৪১তম সম্মেলনে জিসিসি নতুন একটি অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। 

জিসিসি মহাসচিব নায়েফ ফালাহ আল-হাজরাফ

কি বলছে সৌদি আরব?

সোমবার সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, এবারের জিসিসি সম্মেলন হবে অন্তর্ভূক্তিমূলক। আমাদের অঞ্চলের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশগুলোকে পুনর্মিলন ও সংহতির দিকে নিয়ে যাওয়াই এই সম্মেলনের লক্ষ্য। কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ নাসের আল সাবাহ বলেছেন, সৌদি আরব কাতারের সঙ্গে স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথ খুলে দিতে রাজি হয়েছে।  

গত মাসে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ উপসাগরীয় কূটনৈতিক সঙ্কটের অবসানে সব দেশের চেষ্টায় একটি প্রস্তাবনা তৈরি হচ্ছে বলে জানান। একই সঙ্গে শিগগিরই একটি চূড়ান্ত চুক্তির প্রত্যাশা করেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, আমাদের অংশীদারদের সঙ্গে আমরা পূর্ণাঙ্গ সমন্বয় করছি। আমরা একটি প্রস্তাবনা তৈরি করছি- এতে সব পক্ষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের সমাধান থাকবে।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের এই সঙ্কটের সমাধানে অবরোধ আরোপকারী দেশগুলো ওয়াশিংটনের তীব্র চাপের মুখে আছে। এই অঞ্চলে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করতে উপসাগরীয় দেশগুলোর ঐক্য চায় ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন।  

 কী করবে বাহরাইন আমিরাত?

মধ্যপ্রাচ্যে পুনর্মিলনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে সমর্থন জানিয়েছে মিসর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সমঝোতা করতে রাজি আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ এক বিবৃতিতে বলেছেন, সঠিক পথেই এগোচ্ছে জিসিসি।

এক টুইটে তিনি বলেছেন, আল-উলায় আমরা ঐতিহাসিক এক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছি। এই সম্মেলনে উপসাগরীয় ঐক্য, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। 

অন্যদিকে, সমুদ্র সীমান্তের সুরক্ষা নিয়ে কাতারের সঙ্গে বারবার সংঘাতে জড়িয়েছে বাহরাইন। গত কয়েকমাসে কাতারের নৌবাহিনী সমুদ্রে নিজেদের জলসীমায় বাহরাইনের যান একাধিকবার আটক করেছে। 

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে লেখা এক চিঠিতে কাতার বলছে, গত ৯ ডিসেম্বর কাতারের আঞ্চলিক জলসীমার আকাশে অন্তত চারটি যুদ্ধবিমান উড়িয়েছে বাহরাইন।

আল-উলায় যোগ দিয়েছে কাতারও

জিসিসির প্রত্যেক বছরের সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাওয়ার পরও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি ২০১৭ সালের পর থেকে একবারও অংশ নেননি। এর পরিবর্তে তিনি কূটনীতিক এবং সরকারের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জিসিসির সম্মেলনে পাঠিয়ে দেন।

তবে সোমবার রাতে কাতার সরকারের যোগাযোগবিষয়ক অফিস মঙ্গলবারের সম্মেলনে আমির শেখ তামিম অংশ নিচ্ছেন বলে নিশ্চিত করে। উপসাগরীয় অঞ্চলে দীর্ঘদিনের বিভাজনের যে সুর ভেসে বেড়াচ্ছিল সম্মেলনে কাতারের আমিরের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এবারে তা স্থিমিত হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

বার্ষিক এই সম্মেলনে বাদশাহর পরিবর্তে ক্রাউন প্রিন্সের প্রতিনিধি পাঠিয়েছে বাহরাইন। অন্যদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রতিনিধি হিসেবে দুবাইয়ের শাসক ও দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্টকে আল-উলায় পাঠিয়ে দিয়েছে।

সমাধান কি আসছে?

গত ২২ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গারগাশ উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশ কাতার সঙ্কটের অবসানে সমাধানের জন্য মুখিয়ে আছে বলে টুইট করেন। 

দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক এই টানাপোড়েনের পাশাপাশি করোনাভাইরাস মহামারি মধ্যপ্রাচ্যে আরেক সঙ্কট তৈরি করেছে। ঐক্যবদ্ধ একটি ব্লকের মাধ্যমে জিসিসিভূক্ত দেশগুলো এ দুই সঙ্কটের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে।

তবে জিসিসির ছয় সদস্য দেশের বার্ষিক সম্মেলনে করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট উতড়ে যাওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

সূত্র: আলজাজিরা, এএফপি, রয়টার্স।

এসএস