কেন্দ্রীয় সরকার সমাধানের জন্য মাঝামাঝি কোনো রাস্তা বের করতে কৃষক নেতাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে

কৃষি সংস্কার আইন নিয়ে গেল বেশ কিছুদিন ধরে বেশ বিপাকে ভারত সরকার। ভারতের হাজারো কৃষক কয়েকদিন ধরেই রাজধানী নয়া দিল্লির কাছে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে আসছেন। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার সমাধানের জন্য মাঝামাঝি কোনো রাস্তা বের করতে কৃষক নেতাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। 

তবে সমাধানের পথ খুব একটা এখনও দেখা যাচ্ছে না। বরং কৃষক নেতারা আগের মতোই আইন প্রত্যাহারের  দাবিতে অনড়। 

এ পর্যন্ত ছয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে দুপক্ষে। প্রথমে সচিব পর্যায়ের আলোচনা, পরে মন্ত্রী পর্যায়ে। তারপরে মঙ্গলবার রাতে অমিত শাহের সাথেও আলোচনা হয়েছে। তবে কৃষকদের বোঝানোর প্রয়াসে কার্যত এখনও কেউ সফলতার মুখ দেখেননি। 

গত শনিবার এমন খবরও পাওয়া যায় যে, বিষয়টি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তার জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।  

এভাবে বারবার আলোচনা পথ খোলা রেখে ভারত সরকার আসলে কৃষকদের এই ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করছে  যে, সরকার তার অবস্থানে অনড় নয়। কৃষকদের দাবি-দাওয়া তারা আন্তরিকতার সাথে বিবেচনা করছে। বুধবার আইনটির কিছু সংশোধন করার জন্য লিখিত প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। তবে কৃষকরা সরকারের লিখিত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন।

একই সঙ্গে সরকার এও আসলে পরিষ্কারভাবে বলে দিচ্ছে যে নতুন কৃষি আইন প্রত্যাহার করা হবে না।

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে যে সরকার কেন এই আইন প্রত্যাহার করতে রাজি নয়? এর পেছনে কি কেবল রাজনৈতিক কারণ রয়েছে না-কি কৃষিক্ষেত্রের অর্থনীতিও এর সাথে জড়িত? কানাডা এবং ব্রিটেন থেকে যেভাবে কৃষকদের সমর্থনে আওয়াজ উঠছে, আন্তর্জাতিক কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। 

এ বিষয়ে কয়েকজন সাংবাদিক এবং কৃষি বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি। 

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নিস্তুলা হেবর বলছেন, সরকার বিশ্বাস করে যে এই আইনগুলো কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয়। তাই এই সংস্কারগুলো কেবল এনডিএর আমলে নয়, ইউপিএর আমলেও এর কথা হয়েছিল। শারদ পাওয়ারের চিঠিগুলি থেকেও তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলেরই না তা করার ইচ্ছাশক্তি ছিল, না সংসদে তাদের প্রয়োজনীয় আসন ছিল। বিজেপি কেন্দ্রে ৩০০-এর বেশি আসন নিয়ে এসেছে। কৃষিক্ষেত্রে এই সংস্কার যদি এখন আলোর মুখ না দেখে তবে আর কখনই তা আলোর মুখ দেখবে না।  

এর আগে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে জমি অধিগ্রহণ বিল নিয়ে এসেছিল। তখনও তাকে পিছু হটতে হয়েছিল। সেই সময় রাহুল গান্ধী সংসদে কেন্দ্রীয় সরকারকে 'স্যুটবুটওয়ালাদের সরকার' বলে স্লোগান দিয়েছিলেন। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কৃষিমন্ত্রী পর্যন্ত বিভিন্ন মহল থেকে নতুন এই আইনগুলো কৃষকদের জন্য ঐতিহাসিক ও উপকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এত কিছুর পরেও এই আইন প্রত্যাহার করা সরকারের জন্য কলঙ্কজনক হবে। 

এখানে আরও একটি বিষয় বুঝতে হবে যে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘও (আরএসএস) ভূমি সংস্কার আইনে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে ছিল না। তবে এবার আরএসএসের সাথে জড়িত স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ বা ভারতীয় কিষাণ সংঘের মতো কৃষক সংগঠনগুলোও বলছে এই আইনগুলো কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করবে। তবে তারা কিছু সংস্কার চায়। 

ভারতের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ দু'দিন আগে একটি সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন যে কীভাবে কংগ্রেস, এনসিপি এবং অন্যান্য দলগুলো নিজ নিজ সময়ে এই জাতীয় আইনকে সমর্থন করেছিল। 

২০১২ সালের কংগ্রেসের ইশতেহারের বিবরণ দেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন যে গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস এপিএমসি আইন বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ সংক্রান্ত শারদ পাওয়ারের লেখা একটি চিঠি, বিজেপি নেতারা বারবার টুইট করছেন। শারদ পাওয়ার ও কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়াও এসেছে। 

একইভাবে দিল্লিতে যেখানে আম আদমি পার্টির সরকার রয়েছে, সেখানে তিনটি আইনের একটি কার্যকরও করা হয়েছে। অন্যদিকে, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল কৃষকদের সাথে দেখা করতে এবং তাদের সমর্থন দিতে গেছেন। 

সে কারণেই সরকার মনে করছে যে কেবল প্রতিবাদ করার জন্যই নতুন আইনটির বিরোধিতা করা হচ্ছে। 

পুরো বিষয়টিতে একটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোনও রয়েছে। এছাড়া দেশটির অনেক কৃষি বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, কৃষিপণ্যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিয়ে কৃষকদের যে দাবি রয়েছে তা ভারতের কৃষিক্ষেত্রকে উপকৃত করবে না। 

দক্ষিণ এশিয়া খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে কাজ করা অধ্যাপক প্রমোদ কুমার যোশি বলছেন যে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে একটি দেশ কৃষককে কৃষি জিডিপির ১০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দিতে পারে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের সাথে জড়িত দেশগুলো এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যেসব দেশ ১০ শতাংশে বেশি ভর্তুকি দেয় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যের বিষয়ে নিয়ম ভাঙছে। 

কৃষি ব্যয় ও মূল্য কমিশনের (সিএসিপি) চলতি বছরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ভারতে বহু ফসলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি। 

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মনে করে যে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার কৃষকদের নতুন আইনের বিষয়ে আপত্তি আছে। বাকি রাজ্যের তুলনায় এ দুই রাজ্যে মান্ডি ব্যবস্থা অনেক ভালো। 

এই রাজ্যদুটিতে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের রমরমা কারবার চলছে, যারা করের নামে কিছু না করেই মোটা অর্থোপার্জন করে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) সুবিধাপ্রাপ্ত ফসলগুলোও সবচেয়ে বেশি এ দুই রাজ্যেই জন্মে। 

সরকার মনে করে যে এই দুটি রাজ্যের বাইরে এই নতুন আইনের খুব একটা বিরোধিতা নেই, কারণ দেশের বেশিরভাগ কৃষক আজও তাদের ফসল মান্ডির বাইরে বিক্রি করছেন। 

২০১৫ সালে একটি কমিটি তার প্রতিবেদনে বলেছিল যে, মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক এমএসপির সুবিধা পান। অর্থাৎ ৯৪ শতাংশ কৃষক কখনও এমএসপির সুবিধা পাননি। 

২০১৫-১৬ সালে পরিচালিত কৃষি শুমারি অনুসারে, ভারতে ৮৬ শতাংশ কৃষকের কাছে ছোট জোতের জমি রয়েছে বা তারা হলো সেই কৃষক যাদের কাছে দুই হেক্টরের কম জমি রয়েছে।  

তবে এখানে ভারত সরকারের একটি ছোট্ট হিসাবে ভুল হয়েছে তা হলো- তারা বোঝেনি যে এত সংখ্যক কৃষক শেষ পর্যন্ত দিল্লি পৌঁছে যাবে। এই ইস্যুতে কৃষকরা মঙ্গলবার যে ভারত বন্ধের ডাক দেয় উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশের মতো বিজেপিশাসিত রাজ্যে তার মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। 

দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বারানসি সফরকালে কৃষকদের বলেছিলেন, আমার বিশ্বাস যে কৃষকরা আজ কৃষি সংস্কার বিল নিয়ে সংশয়ে রয়েছে, তারাও ভবিষ্যতে এই কৃষি সংস্কারের সুযোগ নিয়ে তাদের আয় বৃদ্ধি করতে পারবে। 

যেসব কারণে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন এই আইন প্রত্যাহার করতে চায় না এটা তার মধ্যে অন্যতম। 

আউটলুক ম্যাগাজিনের রাজনৈতিক সম্পাদক ভাবনা বিজ অরোরো বলছেন, আমি এই বিষয়ে বিজেপির অনেক নেতার সাথে কথা বলেছি। সরকার মনে করছে এই সংস্কার ঐতিহাসিক। কৃষকরা ভবিষ্যতে বুঝতে পারবেন যে এই সংস্কারের ফলে তারা কতটা লাভনান হয়েছেন এবং তারপরে এই কৃষকরাই তাদের ধন্যবাদ জানাবেন। প্রতিটি সংস্কারের আগেই এ জাতীয় আন্দোলন ঘটে। তবে এবার সরকারও দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। 

ভাবনা আরও বলছেন যে, নতুন আইনের সংশোধনীর বিষয়ে সরকারের এই রাজি হওয়াটাই প্রমাণ করে যে তার অবস্থান আগে চেয়ে নমনীয় হয়েছে। তবে, সরকার ভবিষ্যতে আইন প্রত্যাহার না করার দাবিতে কতক্ষণ স্থির থাকতে সক্ষম, তাও দেখার বিষয় হবে। 

কেন্দ্রীয় সরকার ২০২২ সালে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা মনে করে যে এই প্রতিশ্রুতি পূরণে এই আইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। 

এনএফ