ইসরায়েলের হবু প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট; এক সময় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে অপসারণে ঐক্যের সরকার গঠনে সমঝোতায় পৌঁছেছেন দেশটির ডান-বাম-মধ্যপন্থী ছোট বড় বেশ কয়েকটি দল। পার্লামেন্টে এই জোটের সরকার গঠনের প্রস্তাব আগামী সপ্তাহে অনুমোদন পেলে নেতানিয়াহুর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন নাফতালি বেনেট।

মাত্র ৪৯ বছর বয়সী এই টেক মিলিওনেয়ার ও সাবেক মন্ত্রীর রাজনৈতিক দর্শন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর চেয়েও উগ্র। দেশটির পরবর্তী এই প্রধানমন্ত্রী অধিকৃত পশ্চিম তীরকে দখলের স্বপ্ন দেখেন। অতীতে অতি-কট্টরপন্থী ইসরায়েলি এই নেতা নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‌‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ইসরায়েলের জন্য হবে আত্মঘাতী।’

কে এই নাফতালি বেনেট?

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিরোধিতাকারী ইসরায়েলের কট্টর ইহুদিবাদী রাজনৈতিক দল ইয়ামিনা পার্টির প্রধান বেনেট। তার এই দল পশ্চিম তীরের বেশিরভাগ অঞ্চল দখলে নিতে চায়। যদিও পশ্চিম তীরের কিছু এলাকা ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের সময় দখলে নেয় ইসরায়েল।
মাত্র ৭টি আসনে জয় নিয়ে ইসরায়েলের রাজনীতিতে বেনেটের উত্থান ঘটেছে কিং মেকার হিসেবে

পশ্চিম তীর দখলে ভোট বাড়বে এমন ধারণা বেনেটের মস্তিষ্কপ্রসূত; আর তার এই ধারণাকে এক যুগ ধরে শুধুমাত্র এগিয়ে নিয়েছেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ইরানের ব্যাপারেও বেনেটের অবস্থান অত্যন্ত কট্টর। তবে নেতানিয়াহুকে অপসারণে নতুন ঐক্যের সরকার গঠনে এক ছাতার নিচে যে রাজনৈতিক দলগুলো এসেছে; তাদের বেশিরভাগেরই অনেক সময় মতাদর্শগত সাংঘর্ষিক অবস্থান দেখা গেছে। আর বেনেটও এক সময় ছিলেন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ।

সমঝোতার সরকার গঠিত হলেও এই দলগুলোর মধ্যে সামনে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে-বিপক্ষের অবস্থান নিয়ে যে টানাপড়েন তৈরি হবে তা অনেকটাই পরিষ্কার। শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাস মহামারি পরবর্তী দেশের অর্থনীতির চাকা সঠিক পথে ফেরানো নিয়েও জটিলতা তৈরি হতে পারে।

মাত্র সাতটি আসনের ছোট্ট একটি রাজনৈতিক দলের নেতা বেনেট কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর আসনে?

২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ইসরায়েলে অন্তত চারবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ গত মার্চে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১২০ আসনের ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটের সব আসন ভাগাভাগি হয়ে যায় মোট ১৩টি দলের মধ্যে।

অতি-কট্টর ইহুদিবাদী নাফতালি বেনেট পশ্চিম তীর পুরোপুরি দখলের স্বপ্ন দেখেন

এই নির্বাচনে মাত্র সাতটি আসনে জয় পায় বেনেটের ইয়ামিনা পার্টি। কপাল খুলে যায় বেনেটের; ইসরায়েলের রাজনীতিতে তিনি হাজির হয়েছেন ‌‘কিং মেকার’ হিসেবে।

বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদের নতুন জোটে যোগ দেওয়ার শর্ত অনুযায়ী— ক্ষমতার মেয়াদের প্রথম দুই বছর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন নাফতালি বেনেট। সংখ্যাগরিষ্ঠ জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু প্রথমে পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন।

এরপর জোট সরকার গঠনে ২ জুন পর্যন্ত ২৮ দিনের সময় পান ইয়ার লাপিদ। তিনি দেশটির বেশ কয়েকটি ছোট বড় রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সরকার গঠনে ঐক্যমতে পৌঁছান। বেনেটের দুই বছরের প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষে ২০২৩ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসবেন লাপিদ।

বেনেটের অতীত?

নাফতালি বেনেট ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর একটি এলিট শাখার কমান্ডো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত নিরাপত্তা কোম্পানি কিয়োটা ইনকরপোরেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বেনেট একজন টেক উদ্যোক্তাও। যদিও তার এই প্রতিষ্ঠান আরএসএ সিকিউরিটি এলএলসির কাছে ১৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি।

২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বেনেট। পরে নেতানিয়াহুর সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিরোধ দেখা দিলে লিকুদ পার্টি ছেড়ে ইহুদি বসতিস্থাপনকারী পরিষদে যোগ দেন।

এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নাফতালি বেনেট নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের তৎপরতায় নেতানিয়াহুর প্রধানমন্ত্রিত্বের অবসান

বেনেট রাজনীতিতে পা রাখেন ২০১২ সালে একটি কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান হন তিনি। দেশটির মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন বেনেট। ধর্মীয় কল্যাণবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর একে একে শিক্ষা এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

ইসরায়েলকে একটি ইহুদি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান অতি কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত বেনেট। অতীতে অনেক সময় জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি মালিকানা ইসরায়েলের বলে দাবি করেছিলেন তিনি।

বেনেট দর্শন

•‌ বিশ্বের সর্ববৃহৎ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হচ্ছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ
• ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ইসরায়েলের জন্য হবে আত্মঘাতী
• বিশ্ব শক্তিগুলোর সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি একটি অনিরাময় বিপর্যয়

রোববার বেনেট বলেছেন, মতাদর্শগত কিছু বিষয়ে জোটের ডান এবং বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে কিছু ছাড় দিতেই হবে।

বেনেটের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা

১৯৭২ সালে ইসরায়েলের হাইফা শহরে জন্ম নাফতালি বেনেটের। অভিবাসী হিসেবে বেড়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো শহরে। আধুনিক-অর্থোডক্স ইহুদি ধর্মের অনুসারী বেনেট।

স্ত্রী ডেজার্ট শেফ গিলাটের সঙ্গে সংসারে রয়েছে চার সন্তান। রাজধানী তেলআবিবের উপশহর রা’নানায় বসবাস করেন তিনি।নেতানিয়াহুর মতো আমেরিকান ইংরেজিতে পটু বেনেট পড়েছেন জেরুজালেমের হেব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে।

সূত্র: ব্লুমবার্গ, রয়টার্স, বিবিসি।

এসএস