ভিন ধর্মে বিয়ে ঠেকাতে ভারতের তিন রাজ্যে সম্প্রতি কার্যকর করা ‘ধর্মান্তরণ প্রতিরোধী আইনের’ বৈধতা খতিয়ে দেখতে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারসহ উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচল প্রদেশ সরকার বরাবর নোটিশ দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।

নোটিশে এই আইন কার্যকর করার বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছেন ভারতের শীর্ষ আদালত। আগামী ৪ সপ্তাহ পরে এ বিষয়ে ফের শুনানির দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এর মধ্যেই নোটিশের জবাব দিতে হবে কেন্দ্রসহ ভারতের এই তিন রাজ্যের সরকারকে।  

ভারতের সংবিধানে যেখানে ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমানাধিকার এবং বৈষম্যহীনতার কথা বলা হয়েছে, সেখানে এই আইন দেশের সংবিধানের সঙ্গে কতখানি যুক্তিযুক্ত – প্রশ্ন তুলে একাধিক পিটিশন জমা পড়েছিল আদালতে। এগুলোর মধ্যে আইনজীবী বিশাল ঠাকরে এবং তিস্তা শেতলওয়াড়ের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সিটিজেন ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস’ এর দায়ের করা পিটিশন আমলে নিয়ে বুধবার এই আদেশ দেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত।

আদালতে জমা পড়া পিটিশনগুলোতে এই আইনের ওপর স্থগিতাদেশ আরোপের আর্জি জানানো হলেও এখনই সেই আদেশ দিতে রাজি হননি সুপ্রিম কোর্ট। এ বিষয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক পত্রিকা আনন্দবাজারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই তিন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে নোটিশের জবাব পেলে বিষয়টি নিয়ে শুনানি করবে ভারতের প্রধান বিচারপতি এসএ বোবদের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ।

ভিন ধর্মে বিয়ে রুখতে দীর্ঘ দিন ধরেই ‘লাভ জিহাদ’ তত্ত্ব তুলে ধরছে ভারতের ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। মূলত হিন্দু ঘরের মেয়েদের মুসলিম ছেলেদের সঙ্গে বিয়ে হওয়াতেই আপত্তি তাদের। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, ধর্মান্তরিত করার লক্ষ্যেই হিন্দু মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেন মুসলিম যুবকরা।

তবে মুসলিম মেয়েদের হিন্দু ঘরে বিয়েকে এই তত্ত্বের আওতায় ফেলতে নারাজ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো।

দীর্ঘদিন ধরে ‘লাভ জিহাদ’ বিরোধী আইনে পক্ষে অবস্থান নেয়া উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার অবশেষে গতবছর জারি করে ‘ধর্মান্তরণ প্রতিরোধী আইন’। এই আইনে অভিযুক্তের সর্বোচ্চ সাজা নির্ধারণ করা হয় ১০ বছরের জেল এবং এক লাখ রুপি জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো এক বছরের জেল।

বিয়ের দু’মাস আগে সরকারকে নোটিশ না দিলে বিয়ে বাতিল বলে গণ্য হবে বলেও উল্লেখ করা হয় আইনে।

আইনটি পাস হওয়ার পর থেকে উত্তরপ্রদেশে বেশ কয়েকজন ভিন্নধর্মী যুগল ও দম্পতিকে হেনস্তা ও নির্যাতন করার ঘটনা ঘটে। এমনকি ভুয়া অভিযোগে মুসলিম যুবকদের কারাবন্দি করে রাখার ঘটনাও প্রকাশিত হয় একাধিক সংবাদমাধ্যমে। সম্প্রতি ভারতের শতাধিক সাবেক আইএএস কর্মকর্তা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন। সেখানে উত্তরপ্রদেশকে ঘৃণার রাজনীতি, বিভাজন ও ধর্মান্ধতার কেন্দ্র বলে উল্লেখ করেন তারা।

কিন্তু তারপরও ‘লাভ জিহাদের’ অজুহাতে সহিংসতার ঘটনা রোখা যায়নি। উত্তরপ্রদেশের পর হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতেও ‘ধর্মান্তকরণ প্রতিরোধী আইন’ কার্যকর করার প্রস্তুতি শুরু করেছে। বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ড প্রদেশে দু’বছর আগে বিয়ের নামে ধর্মান্তরণ প্রতিরোধী আইন পাস হলেও, সম্প্রতি সেই আইনের দোহাই দিয়ে একাধিক মানুষকে হেনস্তা করার ঘটনা সামনে আসে।

এমনকি বাদ যায়নি হিমাচল প্রদেশও। খ্রিস্টান মিশনারিদের হাতে ব্যাপক ধর্মান্তরণের ঘটনা রুখতে ২০০৬ সালে হিমাচলের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ধর্মান্তরণ প্রতিরোধী আইন পাশ করে। ২০১৭ সালে সেখানে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। তার পর ২০১৯ সালে জয়রাম ঠাকুরের সরকার তাতে বেশ কিছু সংশোধন করে আইনটিকে আরও কঠোর করে তোলে। বিরোধী কংগ্রেসের সমর্থনেই সেটি রাজ্য বিধানসভায় পাস হয়ে যায়।

তার পরে এতদিন সেটি পড়ে থাকার পর, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে আইনটি কার্যকর করে হিমাচল রাজ্য সরকার।

এসএমডব্লিউ