পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সীমান্ত সংঘাতের নেপথ্যে কী?
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে ভয়াবহ সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। শনিবার রাতের আকস্মিক হামলা-পাল্টা হামলায় দুই প্রতিবেশীর মাঝে নতুন করে যুদ্ধের দামামা বাজছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর দুই প্রতিবেশীর মাঝে এবারের এই সংঘাতকে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে মনে করা হচ্ছে। নতুন করে এই সংঘাতের জন্য উভয় দেশই পরস্পরকে দোষারোপ করছে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার রাতে বিনা উসকানিতেই আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। জবাবে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সীমান্ত তল্লাশি চৌকি ও সন্ত্রাসীদের অবস্থান লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। দুই দেশের সীমান্তের আঙ্গুর আড্ডা, বাজাউর, কুররম, দীর, চিত্রাল ও বাহরাম চাহ এলাকায় রাতভর ব্যাপক সংঘাত হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
পাকিস্তান সেনাবাহিনী বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কামানের গোলা, ট্যাংক ও ড্রোন ব্যবহার করে আফগানিস্তানের অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। একই সময়ে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ১৯টি সীমান্ত চৌকি দখলে নেওয়ার দাবি করেছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল পিটিভি ভিডিও প্রকাশ করে বলেছে, পাক সৈন্যদের হামলায় আফগান সীমান্ত চৌকিতে আগুন ধরে গেছে। কুররমে আফগান সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছেন বলেও দাবি করেছে পিটিভি। পাকিস্তান বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তালেবানের কয়েকটি স্থাপনা ধ্বংস করেছে। এসব স্থাপনার মধ্যে ছিল মানোজবা ব্যাটালিয়নের সদরদপ্তর ও খরচার দুর্গ।
প্রতিবেশী দুই দেশের মাঝে এমন এক সময়ে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, যার কয়েক দিন আগেই আফগানিস্তান অভিযোগ করে বলেছিল, রাজধানী কাবুলসহ পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি প্রদেশে বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। তবে ইসলামাবাদ এই অভিযোগ স্বীকার কিংবা অস্বীকার করেনি।
• কী বলছে পাকিস্তান?
পাকিস্তানে আফগানিস্তানের হামলাকে ‘বিনা উসকানিতে আগ্রাসন’ বলে দাবি করেছে ইসলামাবাদ। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি বলেছেন, ‘‘বেসামরিক জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের স্পষ্ট উদাহরণ এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্রুত ও কার্যকর জবাব দিয়েছে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ও প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ আফগানিস্তানের এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তারা জোর দিয়ে বলেছেন, জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য পাকিস্তান কোনও ধরনের আপস করবে না।
প্রেসিডেন্ট জারদারি বলেন, পাকিস্তানে বিভিন্ন সময়ে যেসব সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তার সবই আফগান ভূখণ্ড থেকে পরিচালিত হচ্ছে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রমাণ করেছে।
তিনি তালেবান প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আফগান ভূখণ্ড থেকে সক্রিয় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ‘‘বাস্তব ও নিরপেক্ষ পদক্ষেপ’ গ্রহণ করতে হবে। সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদকে তিনি ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি’ বলে অভিহিত করেছেন।
পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) অতীতে বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানে হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতিতে দিয়েছে। এই গোষ্ঠীটি বর্তমানে আফগানিস্তানে নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছে বলে দাবি করেছে পাকিস্তান।
• আফগানিস্তান কী বলছে?
কাবুলের তালেবান সরকার অভিযোগ করেছে, আফগানিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে গত বৃহস্পতিবার রাজধানী কাবুলসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাণঘাতী বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। আফগান কর্মকর্তারা বলেছেন, বার বার আকাশসীমা লঙ্ঘনের জবাবে শনিবার রাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
তালেবান সরকারের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, আফগান বাহিনী তিনটি পাকিস্তানি সীমান্ত চৌকি দখল এবং ৫৮ জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেছে। এছাড়া আফগান সৈন্যদের হামলায় পাকিস্তানের আরও ৩০ সৈন্য আহত হয়েছেন। তিনি পাকিস্তানকে ‘বলপ্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এই ধরনের পদক্ষেপের পরিণতি হবে অত্যন্ত বিপজ্জনক।
মুজাহিদ অভিযোগ করে বলেন, ‘পাকিস্তানের কিছু মহল আফগানিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে চায়।’
আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অভিযান শনিবার মধ্যরাতে শেষ হয়েছে। তবে পাকিস্তান আবার আফগানিস্তানের আকাশসীমা ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করলে তার ‘কঠিন জবাব’ দেওয়া হবে। কাবুল টিটিপিকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, আফগানিস্তানের ভূখণ্ড কোনও প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে দেয় না কাবুল।
• আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইরান, সৌদি আরব ও কাতার উভয় দেশকে সংযম ও সংলাপে বসার পাশাপাশি উত্তেজনা প্রশমনে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সৌদি আরব বলেছে, তারা পাকিস্তান-আফগানিস্তানের পরিস্থিতি উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। উভয়পক্ষকে ‘সংলাপ ও প্রজ্ঞার পথে’ চলার আহ্বান জানায় রিয়াদ। কাতারও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ‘সংঘাত নয়, বরং কূটনীতির’ পথ বেছে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
• কেন এই উত্তেজনা?
গত কয়েক মাস ধরে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্কে মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। ইসলামাবাদ অভিযোগ করে বলেছে, আফগান ভূখণ্ড থেকে পরিচালিত একাধিক প্রাণঘাতী আন্তঃসীমান্ত হামলায় পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।
পাকিস্তান বলছে, সীমান্ত প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বার বার হামলার ঘটনায় কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী তালেবানের মিত্র টিটিপি সম্প্রতি পাকিস্তানে একাধিক প্রাণঘাতী হামলার দায় স্বীকার করেছে। এর মধ্যে কেবল চলতি সপ্তাহেই টিটিপির এক হামলায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাসহ অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন।
২০২১ সালের আগস্টে তালেবান কাবুল দখল করার পর পাকিস্তান সীমান্ত নিরাপত্তা ও সহযোগিতার উন্নতির প্রত্যাশা করেছিল। বিপরীতে প্রতিবেশী দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। উভয় পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন ও জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করছে।
রোববার তোর্খাম সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরও পরিষ্কার হয়েছে। এই সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় দুই দেশের বাণিজ্য ও যাতায়াত মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
এসএস