১৯৮৮ সালে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে বিচারবহির্ভূত হত্যায় ইরানের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির ভূমিকার পুরনো অভিযোগের তদন্ত করতে নতুন করে আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। শনিবার যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই মানবাধিকার সংস্থা ইরানের কট্টরপন্থী নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির বিরুদ্ধে তদন্তের এ আহ্বান জানিয়েছে।

সেই সময়ের এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কখনই স্বীকার করে না ইরান। এছাড়া এই হত্যাকাণ্ডে নিজের ভূমিকার অভিযোগের ব্যাপারেও কখনও জনসম্মুখে মন্তব্য করেননি রাইসিও। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের শুরুর বছরগুলোতে সশস্ত্র বিরোধীদের নির্মূলে সংক্ষিপ্ত সময়ের বিচারে হাজারও মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ইরানে। দেশটির কিছু ধর্মীয় নেতা বলেছেন, বিচারকার্য সুষ্ঠু ছিল। ওই বিচারকার্যের প্রশংসা করেন তারা। সেই সময় দেশটির বিচার বিভাগের বিচারক ছিলেন রাইসি।

তবে তেহরানের চিরবৈরী প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়াশিংটন এবং বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ইরানে ভিন্ন মত দমনে রাজনৈতিক বন্দিদের বিচারবহির্ভূত উপায়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার লোকজন কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং তাদের মরদেহ কোথায়— আজ পর্যন্ত ইরানি কর্তৃপক্ষ তা পরিকল্পিতভাবে গোপন করেছে; যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।

এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে শুক্রবারের নির্বাচনে জয়ী রাইসির ভূমিকার ব্যাপারে অতীতেও তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিল অ্যামনেস্টি। ১৯৮৮ সালের বিচারবহির্ভূত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে রাইসির ভূমিকার ব্যাপারে ২০১৮ সালে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল অ্যামনেস্টি। সেই নথির কথা উল্লেখ করে অ্যামনেস্টির প্রধান বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমরা রাইসির বিরুদ্ধে অতীতের এবং বর্তমান অপরাধের তদন্তের আহ্বান জানাই।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও দেশটিতে যে মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটেছে সে ব্যাপারেও কট্টরপন্থী এই বিচারকের সংশ্লিষ্টতার তদন্তেরও আহ্বান জানিয়েছেন ক্যালামার্ড।

ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট রাইসি

ইরানের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন দেশটির কট্টরপন্থী বিচারক ইব্রাহিম রাইসি। শুক্রবার দেশটিতে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রায় ৬২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন তিনি। ইরানের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বলছে, এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট পড়েছে ২ কোটি ৮০ লাখের বেশি। যদিও দেশটির ভোটার সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৯০ লাখ। 

রাইসিকে নির্বাচিত করতে সব পরিকল্পনা সাজিয়ে ভোটের আয়োজন করা হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করছেন। তবে নির্বাচনে জয়ের পর সমর্থনের জন্য ইরানিদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন রাইসি। 

ইরানের চলতি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতার আবেদন করেছিলেন প্রায় ৬০০ জন, তাদের মধ্যে ৪০ জন ছিলেন নারী। কিন্তু দেশটির ক্ষমতাসীন কট্টরপন্থী সরকারের প্রভাবশালী সংগঠন গার্ডিয়ান কাউন্সিল রাইসিসহ ৭ জন ছাড়া অন্যান্য সবার প্রার্থিতা বাতিল ঘোষণা করে। এই সাতজনের মধ্যে তিনজন নির্বাচনের আগেই প্রার্থিতার আবেদন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রার্থী থাকেন ৪ জন।

সেই অনুযায়ী চলতি বছর দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা প্রার্থীরা হলেন ইব্রাহিম রাইসি, আবদুল নাসের হেমাতি, মহসিন রেজাই ও আমির হোসেন ঘাজিজাদ্দেহ হাসেমি।

ইব্রাহিম রাইসি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান ছিলেন। সেই হিসেবে নির্বাচনের আগে থেকেই তিনি দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারের বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত তিনি।

কে এই রাইসি

ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান ৬০ বছর বয়সী রাইসি বর্তমানে দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচনী দৌড়ে শামিল হয়েছেন তিনি। এর আগে ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও একবার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই সময় হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হন রাইসি।

দেশটির সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা খামেনি এবং রাইসির জন্ম একই স্থানে; ইরানের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশহাদে। খামেনির মতো না হলেও দেশটির সংখ্যাগুরু শিয়া সম্প্রদায়ের কট্টরপন্থিমহলে তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক।

খামেনির মতো রাইসিরও দাবি, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর রক্তসম্পর্কিত উত্তরাধিকার রয়েছে তার। এ কারণে সবসময় কালো রংয়ের পাগড়ি পরেন তিনি।

তবে ইরানের গণতন্ত্রপন্থী বলয়ে তার জনপ্রিয়তা বেশ কম। কারণ আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় দেশটিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন গণতন্ত্রপন্থীরা, যারা ক্ষমতাসীন ইসলামী কট্টরপন্থী সরকারের বিরোধী। যুদ্ধ শেষে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার কারণে শত শত গণতন্ত্রপন্থিকে গ্রেফতার করা হয় এবং তেহরানের রেভ্যুলুশনারি আদালত সংক্ষিপ্ত বিচারকাজের পরই তাদের অধিকাংশকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। সে সময় রেভ্যুলুশনারি আদালতের প্রধান বিচারক ছিলেন রাইসি।

ওই বিচার প্রক্রিয়ার পরই খামেনির আস্থাভাজন হিসেবে হিসেবে উত্থান ঘটে তার। ২০১৯ সালে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেশনের প্রধান হিসেবে রাইসিকে নিয়োগ দেন খামেনি। ইরানের শিয়া মুসলিমদের কাছে পবিত্র তীর্থ বলে বিবেচিত ইমাম রেজার মাজারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দাতব্য কার্যক্রম ও দেশের অধিকাংশ কোম্পানি পরিচালনাও করে থাকে এই ফাউন্ডেশন।

তিন বছর মোটামুটি সফলভাবে আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেশনের নেতৃত্ব দেওয়ার পর ২০১৯ সালে তাকে বিচার বিভাগের প্রধান পদে নিয়োগ দেন খামেনি। এ পদে থাকার সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে জনপ্রিয়তা কিছুটা বাড়ে তার।

রাইসির রাজনৈতিক দর্শন

নিজেকে ‘দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অভিজাতদের’ ঘোর বিরোধী হিসেবে জাহির করা রাইসি রাজনৈতিক দিক থেকে শিয়া ইসলামী কট্টরপন্থার সমর্থক। দেশের গণতন্ত্রপন্থিদের পাশাপাশি  তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য দেশগুলোরও কঠোর সমালোচক। তবে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি প্রায় পঙ্গু হয়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের বিষয়ে সুর নরম করেছেন তিনি।

দেশের গণতন্ত্রপন্থীদের মতে, যদিও তিনি দুর্নীতি ও অভিজাতদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইরানের বর্তমান যে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ প্রশাসন, তা গঠনে তার ভূমিকা আছে এবং তিনি নিজেও এই প্রশাসনেরই অংশ।

ইরানের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলী রেজা ইশরাঘি দেশটির সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে ‘ফরেন রিলেশনস’ সাময়িকীতে লিখেছেন, ‘এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইরানের রাজনীতিতে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে এবং দেশটির গণতন্ত্রপন্থীদের সঙ্গে রক্ষণশীলদের দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পাবে।’

এসএস