সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় আগে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিধর সৌদি আরব এবং তার চার ঘনিষ্ঠ আরব মিত্র— সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর এবং বাহরাইন হঠাৎ কাতারের ওপর সর্বাত্মক অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক অবরোধ আরোপের ঘোষণা দেয়। সেই সময় উপসাগরীয় অঞ্চলের ক্ষুদ্রে এই দেশটিতে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

খাদ্য সঙ্কটের আতঙ্কে দোকানপাটে হামলে পড়েন স্থানীয়রা। রাজধানী দোহার শেয়ার বাজারে রাতারাতি ধস নামে। অনেক কাতারি নাগরিক মিসর, সৌদি আরব এবং আমিরাতে আটকা পড়েন। কিন্তু মঙ্গলবার যখন কাতারি আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি উপসাগরীয় জোটের এক বৈঠকে যোগ দিতে সৌদি আরবের আল-উলা শহরে নামেন, তখন তাকে রাজকীয় অভ্যর্থনায় বরণ করে নেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্দ বিন সালমান।

আনুগত্য আদায়ে যে ব্যক্তি ছোট্ট প্রতিবেশি কাতারকে হাঁটুর ওপর বসাতে চেয়েছিলেন, ক্ষমতাধর সেই সৌদি যুবরাজ কাতারি আমিরকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে হাজির হন। এরপর নিজে গাড়ি চালিয়ে কাতারের আমিরকে আল-উলার প্রাচীন পুরাকীর্তি ঘুরে ঘুরে দেখান সৌদি যুবরাজ। এসব ভিডিও চিত্র সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় টিভিতে দিনভর দেখানো হয়।

কোনও শর্তই মানেনি কাতার

মজার ব্যাপার হলো— যে অবরোধ আরোপের সময় আলজাজিরা টিভি নেটওয়ার্ক বন্ধ, ইরানের সাথে সম্পর্কে রাশ টানা এবং তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধসহ ১৩টি দাবি ১০ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে সৌদিরা কাতারের হাতে তুলে দেয়, তার একটিও কাতার তোয়াক্কা করেনি।

অবরোধ দিয়ে কাতারিদের প্রতি বৈষম্যের যে মামলা আন্তর্জাতিক আদালতে ওই চারটি দেশের বিরুদ্ধে কাতার করেছিল, শুধু সেই মামলা প্রত্যাহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। অন্য কোনও ছাড়ই দেয়নি। অবরোধ প্রত্যাহার বা সম্পর্ক পুনঃস্থাপন দিয়ে কোনও দেন-দরবারও কাতার করেনি। ওই উদ্যোগ ছিল সৌদি আরবের এবং পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের।

লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সামি হামদি বলেন, সৌদি আরব কাতারের সাথে সমঝোতার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। সৌদিরা যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন সরকার নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। সুতরাং জো বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার আগে বিতর্কিত বিষয়গুলো তারা যতটা সম্ভব ফয়সালা করার চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, কাতারের সাথে সমঝোতায় একেবারেই আগ্রহী ছিল না সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু সৌদির চাপে তাদের রাজি হতে হয়েছে। আমিরাত মনে করে আমেরিকায় নতুন প্রশাসনের কাছ থেকে চাপ আসলেও তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা এখন তাদের রয়েছে। তারপরও সৌদি যুবরাজের কথা হয়তো আবুধাবির যুবরাজ প্রত্যাখ্যান করতে চাননি।

অবশ্য ডোনাল্ড ট্রাম্পও প্রথম দিকে এই অবরোধ নিয়ে মাথা না ঘামালেও সাম্প্রতিক সময়ে কাতার ও সৌদি আরবের মধ্যে সমঝোতায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কুয়েত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই সমঝোতা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে। প্রথমে কথা হয় সৌদি আরব এবং কাতারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নিয়ে, কিন্তু কাতার শর্ত দেয় চুক্তি হতে হবে ব্যাপকভিত্তিক; যেখানে অবরোধকারী বাকি তিনটি দেশকেও আনতে হবে।

ট্রাম্পের প্রবল উৎসাহ

ডোনাল্ড ট্রাম্প তিন বছর চুপ থাকার পর ক্ষমতার শেষ দিকে এসে কাতারের অবরোধ ওঠানো নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠলেন কেন? যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) এক অনলাইন প্রকাশনায় গবেষক জন বি অল্টারম্যান লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রদপ্তর হোয়াইট হাউসকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে কাতারের ওপর অবরোধ অর্থহীন এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে একঘরে করার নীতির জন্য এটি ক্ষতিকর।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র একসময় বুঝতে পারে গ্যাস সমৃদ্ধ কাতার অবরোধ সামলাতে খুবই সক্ষম। মধ্য দিয়ে এই অবরোধ থেকে ইরানের লাভ হচ্ছে।

ইরানের সাথে যৌথভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাস ক্ষেত্রের উন্নয়নে যে কাজ কাতার করছিল, অবরোধ আরোপের পরে সেই সহযোগিতা তারা আরো বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া, সৌদি আরব এবং আমিরাতের আকাশসীমা ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাতার এয়ারওয়েজ বিকল্প হিসাবে ইরানের আকাশসীমা ব্যবহার শুরু করে যার ফি হিসাবে প্রতি বছর ১০ কোটি ডলার তারা ইরানকে দিচ্ছে।

উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সেনাঘাঁটিটি কাতারে। ফলে এই অবরোধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতি নির্ধারকের মধ্যে প্রথম থেকেই অস্বস্তি ছিল। তারা হোয়াইট হাইজকে চাপ দিয়ে গেছে।

অবরোধে শক্ত কাতার

সৌদি আরবের আশা জল-স্থল-আকাশে অবরোধের চাপে কাতারের অর্থনীতির এমন বারোটা বাজবে যে কাতার হাঁটু গেড়ে তাদের দাবি মানতে বাধ্য হবে। প্রথম কয়েক সপ্তাহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল ২৫ লাখ জনসংখ্যার ছোট দেশটিতে। খাবারের সঙ্কটের ভয়ে মানুষজন দোকান পাটে হামলে পড়েন। শেয়ার বাজারে ধস নামে।

কাতারের ৩৭ বছর বয়সী আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি আপোস করতে অস্বীকার করেন। বদলে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ান তুরস্ক এবং ইরানের কাছে। সৌদি আরবের বৈরী ওই দুই দেশ জরুরিভিত্তিতে কাতারে খাবার পাঠায়। সৌদি সামরিক অভিযান চালাতে পারে এই ভয়ে তুরস্কের কাছে সামরিক সাহায্য চায় কাতার। এক বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ায় কাতার।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, অবরোধে কাতারের অর্থনীতির কোনও ক্ষতি হয়নি। বরং তিন বছর পর কাতার খাদ্য উৎপাদনসহ অনেক ক্ষেত্রে এখন স্বাবলম্বী।

 একইসাথে আন্তর্জাতিক মহলে ছোট এই দেশটি তাদের সম্মান এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।

সৌদি আরব এবং আমিরাতের শাসকদের ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষকরাও এখন বলছেন সাড়ে তিন বছরের অবরোধে কিছুই অর্জিত হয়নি। আরব আমিরাতের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আব্দুল্লাহ খালেক আব্দুল্লাহ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, এই অবরোধ কাতারের কোনও অসুবিধাই করতে পারেনি। বরং কাতার এখন ভাবতে শুরু করেছ যে তারা জিতেছে।

সৌদি আরব এবং আমিরাতের বড় ক্ষোভ যে কাতার তাদের নীতির সাথে তাল না মিলিয়ে স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তে ইরান এবং তুরস্কের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করছে। এছাড়া কাতার মধ্যপ্রাচ্যে এমন সব ইসলামী গোষ্ঠী এবং সংগঠনকে সাহায্য করছে যারা সন্ত্রাসে জড়িত, যে অভিযোগ অবশ্য কাতার সবসময় প্রত্যাখ্যান করে।

কাতারি টিভি নেটওয়ার্ক আলজাজিরা নিয়েও চরম ক্ষিপ্ত সৌদি এবং তার তিন মিত্র। তাদের কথা- আলজাজিরা মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো কট্টর ইসলামিদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে এবং আরব সরকারগুলোর সমালোচনায় লিপ্ত। কিন্তু সমঝোতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলার সময় সৌদি বা আমিরাতের শর্ত নিয়ে কোনো কথাই শুনতে চায়নি কাতার।

গত মাসেও ইতালিতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল রহমান আল থানি বলেন, অবরোধ নিয়ে যে কোনো সমঝোতায় কাতার তার সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কোনও আপোস করবে না।

সামি হামদি মনে করেন, কাতার যে ইরান এবং তুরস্কের সাথে সম্পর্ক পুনঃবিবেচনা করবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। ইরানের সাথে কাতারের সম্পর্ককে বাড়িয়ে দেখানো হয়, কিন্তু তুরস্কের সাথে কাতারের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক এখন খুবই ঘনিষ্ঠ এবং কাতার তাকে খাটো করবে না।

মাথা নোয়াচ্ছে সৌদি?

তাহলে কি যে সৌদি আরব কাতারকে পর্যুদস্ত করতে চেয়েছিল, তারা এখন নিজেরাই মাথা নোয়াচ্ছে? সামি হামদি মনে করেন- পরাজয় যতটা না হয়েছে সৌদি আরবের তার চেয়ে বেশি হয়েছে কাতারের ঘোরতর শত্রু সংযুক্ত আরব আমিরাতের।

তিনি বলেন, কাতারের সাথে বড় টক্কর আসলে ইউএই‘র। সৌদিরা অবশ্যই পথ বদলেছে। কিন্তু আমিরাত বাধ্য হচ্ছে সৌদিদের নতুন পথে হাঁটতে। কিন্তু প্রয়োজন না হলেও সম্পর্ক স্থাপনে সমঝোতায় কাতার রাজি কেন হলো?

সামি হামদির মতে, আমিরাত এবং সৌদি আরবের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে চাইছে কাতার এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে তারা সৌদির সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ ছাড়েনি।

‘অমার মনে হয় কাতার এখন চেষ্টা করবে ইউএইর ওপর সৌদিদের যে নির্ভরতা সেটা কমাতে। সৌদি আরবকে হয়তো কাতার দেখাতে চাইবে যে ইউএই তাদেরকে যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফায়দা দিতে পারে, তারা তার চেয়েও বেশি ছাড়া কম পারবে না...তাদের কাছে আল জাজিরা রয়েছে।’

সামি হামদি বলেন, আলজাজিরাতে গত কয়েকদিনে হঠাৎ করে সৌদি আরব নিয়ে “ইতিবাচক“ প্রচার চোখে পড়েছে। সৌদি সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষকদের মতামত নেয়া হচ্ছে। দু’দিন আগে রিয়াদের আধুনিকায়ন নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করেছে তারা।

‘দেখছিলাম টুইটারে একজন মজা করে লিখেছেন আলজাজিরা হয়ত দু’দিন পরে বলবে খাসোগি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন।’

সৌদি-কাতার সমঝোতার মধ্যস্থতায় প্রধান ভূমিকা রেখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাই জ্যারেড কুশনার। কিন্তু দু’দিন পর যিনি ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছেন তাকে গুরুত্ব কেন দিল কাতার? সামি হামদি মনে করেন, অনেক মানুষের মত কাতারিরাও হয়ত মনে করছেন ট্রাম্প নিজে অথবা তার পরিবারের কেউ হয়তো চার বছর পর হোয়াইট হাউসে আবারও ফিরতে পারেন। ফলে ট্রাম্পকে চটাতে চায়নি তারা।

ট্রাম্প এই সমঝোতার বদলে কাতারকে কোনো শর্ত কি দিয়েছেন? তার কোনও স্পষ্ট কোনও ইঙ্গিত এখনও নেই। অবশ্য তেমন কোনো প্রতিশ্রুতি এখন অর্থহীনও কারণ জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে কী করেন অঞ্চলের অন্য সব দেশের মত কাতারও এখন সেই অপেক্ষায়।

এছাড়া এ অবরোধ নিয়ে কাতার এবং সৌদি আরব ও তার মিত্রদের মধ্যে যে অনাস্থা ও তিক্ততা তৈরি হয়েছে তাতে এই বোঝাপড়া কতদিন টিকবে তা নিয়েও অনেক পর্যবেক্ষক সন্দিহান। সিএসআইএসের জন অল্টারম্যান বলেন, বোঝাপড়া হয়েছে কিন্তু ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অবিশ্বাস, অনাস্থা, ক্রোধ দূর হয়নি। তার মতে, আস্থা ফিরতে বছরের পর বছর লাগতে পারে। পরিস্থিতি নতুন সঙ্কটেও মোড় নিতে পারে। বিবিসি বাংলা।

এসএস