পাকিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমাতে চায় আফগানিস্তান
সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনার পর পাকিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমাতে চায় আফগানিস্তান। মূলত পাকিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমিয়ে মধ্য এশিয়ার তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে চায় দেশটি।
যদিও দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানই ছিল কাবুলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, ব্যয় ও রাজনৈতিক জটিলতা আফগানিস্তানের এই চাওয়াকে কঠিন করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞাপন
সোমবার (১৭ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য ডন।
সংবাদমাধ্যম রেডিও ফ্রি ইউরোপের বরাতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থান, উচ্চ ব্যয় এবং রাজনৈতিক জটিলতার কারণে পাকিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমানোর তালেবান সরকারের এই প্রচেষ্টা বাধার মুখে পড়বে। বর্তমানে দেশটি নগদ অর্থের সংকটে রয়েছে এবং দেশটির ক্ষমতাসীনরাও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়।
বিজ্ঞাপন
এর আগে গত মাসে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। সেসময় দু’পক্ষের সামরিক হামলায় বহু মানুষ নিহত হয় এবং আফগান সীমান্ত বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান। সেসময় থেকে প্রায় এক মাস সীমান্ত বন্ধ থাকায় আফগান ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ কোটি ডলার। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছাতে তারা পাকিস্তানের সমুদ্রবন্দরগুলোর ওপরই নির্ভরশীল।
অন্যদিকে পাকিস্তানও আফগানিস্তানে প্রতি মাসে ১০ থেকে ২০ কোটি ডলারের পণ্য — ফল, সিমেন্ট, ওষুধ, সার্জিক্যাল আইটেম, কৃষিযন্ত্র, কাপড়, জুতা, প্লাস্টিক পাইপ, স্যানিটারি সামগ্রী ও প্রসাধনী — রপ্তানি করে আসছিল।
‘বিকল্প বাণিজ্য পথ’ খুঁজছে তালেবান
তালেবান প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ নেতারা আফগান ব্যবসায়ীদের পাকিস্তানের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে মধ্য এশিয়ার দিকে ঝুঁকতে আহ্বান জানিয়েছেন। তালেবান বাণিজ্যমন্ত্রী নূরউদ্দিন আজিজি বলেন, “উত্তরের প্রতিবেশীদের সঙ্গে নির্ভরযোগ্য বিকল্প বাণিজ্য পথ খুঁজতে আমরা কাজ করছি।”
তালেবানের উপ-প্রধানমন্ত্রী আব্দুল গণি বারাদর অভিযোগ করেন, পাকিস্তান বাণিজ্যকে “রাজনৈতিক চাপের হাতিয়ার” হিসেবে ব্যবহার করছে। চলমান সীমান্ত বন্ধই প্রমাণ করে যে আফগানিস্তানের নির্ভরতা কমানো জরুরি।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশেষজ্ঞ তোরেক ফারহাদি বলেন, মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের ওপর জোর দেওয়া মূলত আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পদক্ষেপ প্রদর্শন। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো স্থলবেষ্টিত হওয়ায় আফগানিস্তানকে দূরপথ পাড়ি দিতে হয়। আবার শুল্ক কাঠামোও আফগান রপ্তানি পণ্যের জন্য ব্যয়সাপেক্ষ— বিশেষ করে কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে। ফল-সবজির মতো পচনশীল পণ্যের সংরক্ষণ ও পরিবহনের অবকাঠামোও দুর্বল।
তিনি বলেন, “উত্তরমুখী রুটকে লাভজনক করতে চাইলে শুল্ক কমিয়ে অংশীদার দেশগুলোকে প্রণোদনা দিতে হবে। কিন্তু কাবুল সরকারের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎসই হলো শুল্ক।”
এছাড়া রেলপথসহ গুরুত্বপূর্ণ আন্তসীমান্ত অবকাঠামোর অনেক প্রকল্পই এখনো অসমাপ্ত বা অর্থায়ন নেই। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকায় তালেবান বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের তহবিলও পাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়লেও এখনও তা খুব সীমিত। আফগান কর্মকর্তাদের মতে, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তানের সঙ্গে মোট বাণিজ্য এখন ১.৭ বিলিয়ন ডলার।
তবুও পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল কাবুল
মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়লেও বৈশ্বিক বাজারে পৌঁছানোর জন্য আফগানিস্তানের দ্রুততম ও সবচেয়ে সাশ্রয়ী পথ হচ্ছে পাকিস্তানই। তোরখাম ও চামান সীমান্ত আফগান বাণিজ্যের প্রধান লাইফলাইন। সাম্প্রতিক সংঘাত ও নিয়মিত বন্ধ-খোলার কারণে সপ্তাহের পর সপ্তাহ হাজার হাজার ট্রাক আটকে আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের বিকল্প পথগুলো ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ এবং ঝুঁকিপূর্ণ। আফগান চেম্বার অব কমার্সের সাবেক প্রধান আজারাখশ হাফিজি বলেন, “সমুদ্রবন্দর, ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে যাওয়ার সবচেয়ে দ্রুত ও কম খরচের পথ পাকিস্তানই।”
তিনি বলেন, “সব ধরনের ট্রানজিট রুট খোলা থাকা জরুরি। এতে কেবল আফগানিস্তান ও পাকিস্তান নয়, পুরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক সংযোগই শক্তিশালী হবে।”
টিএম