ভারতে মাতৃদুগ্ধে মিলল ইউরেনিয়াম, বিজ্ঞানীরা বলছেন ঝুঁকি নেই
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারের এক গবেষণায় স্তন্যদানকারী মায়েদের দুধে ইউরেনিয়াম পাওয়ার পর দেশটিতে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই উদ্বেগের বিষয়ে দেশটির জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (এনডিএমএ) এক জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলেছেন, গবেষণার ফলাফল জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনক কিছু নয়। বিহারে মাতৃদুগ্ধের নমুনায় পাওয়া ইউরেনিয়ামের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত সীমার অনেক নিচে রয়েছে।
রোববার দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। দেশটির পারমাণবিক বিজ্ঞানী, এনডিএমএর সদস্য ও ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের সাবেক পরিচালক ড. দীনেশ কে অসওয়াল এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, গবেষণার ফল নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, যে মাত্রা শনাক্ত হয়েছে, তা নিরাপদ সীমার মধ্যেই আছে। আসলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পানীয়জলে যে অনুমোদিত সীমা নির্ধারণ করেছে, তা এই গবেষণায় পাওয়া মাত্রার তুলনায় প্রায় ছয় গুণ।
বিহারের পাটনার মহাবীর ক্যানসার সংস্থান অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লির এআইআইএমএসের কয়েকজন বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে ওই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ব্রিটিশ জার্নাল ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টসে’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিহারের স্তন্যদুগ্ধে সর্বোচ্চ ৫ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) ইউরেনিয়াম পাওয়া গেছে। গবেষণার সহ-লেখক দিল্লির এআইআইএমএসের বিজ্ঞানী ড. অশোক শর্মা বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, গবেষণায় ৪০ জন স্তন্যদানকারী মায়ের দুধ বিশ্লেষণ করা হয় এবং সব নমুনাতেই ইউরেনিয়াম (ইউ-২৩৮) পাওয়া গেছে।
‘‘যদিও এই গবেষণায় ৭০ শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রে সম্ভাব্য নন-কার্সিনোজেনিক ঝুঁকি দেখা গেছে। তবে সামগ্রিক ইউরেনিয়ামের মাত্রা অনুমোদিত সীমার নিচে এবং মা ও শিশুর ওপর প্রকৃত স্বাস্থ্যঝুঁকি খুবই কম বলে ধারণা করা হচ্ছে।’’
দীর্ঘমেয়াদে ইউরেনিয়ামের সংস্পর্শ পেলে তা শিশুদের স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। ড. শর্মা বলেন, এই গবেষণায় যে ফল পাওয়া গেছে, তাতে প্রকৃত স্বাস্থ্যঝুঁকি কম এবং মায়েরা অবশ্যই শিশুদের দুধপান করানো অব্যাহত রাখবেন।
ড. অসওয়াল বলেন, ‘‘উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই। মায়েরা নির্দ্বিধায় শিশুদের বুকের দুধ পান করানো চালিয়ে যাবেন। পানীয়জলে ইউরেনিয়ামের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ সীমা ৩০ পিপিবি; যা বিহারের নমুনায় পাওয়া মাত্রার তুলনায় ছয় গুণ বেশি। অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিমাণের ইউরেনিয়াম পৃথিবীর স্থলভাগে স্বাভাবিকভাবেই মিশে থাকে। এছাড়া স্তন্যদানকারী মায়েদের গ্রহণ করা ইউরেনিয়ামের বেশিরভাগই প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যায়; একেবারে সামান্য অংশ দুধে যায়।
• গবেষণায় কী মিলছে?
মহাবীর ক্যানসার সংস্থান অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের কর্মকর্তা ড. অরুণ কুমার নেতৃত্বাধীন ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানিতে ইউরেনিয়ামের দূষণ মানুষের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। ভারতে ১৮টি রাজ্যের ১৫১টি জেলায় ভূগর্ভস্থ পানিতে ইউরেনিয়াম দূষণ শনাক্ত হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়, এই গবেষণার উদ্দেশ্য হলো স্তন্যদানকারী মায়েদের স্তন্যদুগ্ধে ইউরেনিয়াম দূষণ এবং তাদের দুধপানকারী শিশুদের ওপর এর প্রভাব মূল্যায়ন করা। শিশুরা মায়ের দুধের মাধ্যমে যে ইউরেনিয়ামের সংস্পর্শে আসে তা পরিমাপের জন্য বিহারের বিভিন্ন জেলা থেকে বিক্ষিপ্তভাবে ৪০ জন স্তন্যদানকারী নারী নির্বাচন করা হয়। তাদের লিখিত সম্মতি নিয়ে দুধ সংগ্রহ এবং ইউ-২৩৮ পরিমাপ করা হয়।
‘‘শিশু এবং মায়েদের কার্সিনোজেনিক ঝুঁকি (সিআর) ও হ্যাজার্ড কোটিয়েন্ট (এইচকিউ) হিসেব করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের মায়ের দুধের মাধ্যমে ইউরেনিয়াম-সংস্পর্শ ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। গবেষণার জন্য সংগৃহীত সব স্তন্যদুগ্ধের নমুনায় ইউ-২৩৮ পাওয়া গেছে, যা শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। দেহ থেকে ইউরেনিয়াম বের হওয়ার সময়ভেদে মায়েদের তুলনায় শিশুরা নন-কার্সিনোজেনিক ঝুঁকির জন্য বেশি সংবেদনশীল। গবেষণা বলছে, স্তন্যদুগ্ধে ইউরেনিয়ামের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।’’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব এলাকায় ইউরেনিয়াম-সংস্পর্শের ওপর বৃহত্তর মাত্রায় বায়োমনিটরিং প্রয়োজন।
• গবেষণার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি
স্তন্যদুগ্ধকে শিশুর পুষ্টির ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে শিশুদের বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতার জন্য জরুরি পুষ্টি, অ্যান্টিবডি এবং বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ ছয় মাস কেবল মাতৃদুগ্ধ পান এবং দুই বছর বা তার বেশি সময় পর্যন্ত দুধপান চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে।
• কেন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ
বৈজ্ঞানিক তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপিত কিংবা প্রসঙ্গ ছাড়া প্রকাশিত হলে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। ড. অসওয়াল বলেছেন, এই বিষয়ে ভুল তথ্যের বিস্তার এবং মায়েদের সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রভাব ঠেকানোই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, দুধপান শুধু পুষ্টির বিষয় নয়; এটি একটি জনস্বাস্থ্যগত অগ্রাধিকার। ভিত্তিহীন আশঙ্কায় দুধপান বন্ধ করা মা ও শিশু উভয়ের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছে, পরিবেশগত ঝুঁকির তুলনায় দুধপানের উপকারিতা অনেক বেশি। দুধপান করা শিশুদের সংক্রমণ, স্থূলতা ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি কম থাকে। মায়েদের ক্ষেত্রেও স্তন ও ডিম্বাশয়ে ক্যানসারের ঝুঁকি কমে।
• বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
গবেষণায় পাওয়া ইউরেনিয়ামের মাত্রার তুলনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ সীমা ছয় গুণ বেশি। এই বিশাল ব্যবধান একটি শক্তিশালী সুরক্ষাবিধান দেয়। আন্তর্জাতিক গবেষণায়ও দেখা যায়, ইউরেনিয়ামের শনাক্ত হওয়া এমন স্তর স্বাভাবিক এবং সাধারণত পরিবেশে প্রাকৃতিকভাবে থাকা মাত্রার প্রতিফলন।
ড. অসওয়াল বলেন, জনস্বাস্থ্য সিদ্ধান্তে বিজ্ঞানকেই পথ দেখাতে হবে, ভয়কে নয়। আমাদের অনুসন্ধান প্রমাণ করে যে দুধপান সম্পূর্ণ নিরাপদ।
সূত্র: এনডিটিভি।
এসএস