বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে। তারপর (বৃহস্পতিবার) তিনটি দুর্নীতির মামলায় ৭ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। দুর্নীতির মামলায় শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলেরও ৫ বছর করে দণ্ড দেওয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার বিষয়ে

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব, যদি ভারত চায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই দণ্ড কার্যকর করা বা শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো না। এই সরকারকে মেনে নেয়নি ভারত। এই কারণে এই সরকারের কোনো কথা তারা শুনবে না। দ্বিতীয়ত, একজন রাজনৈতিক নেতাকে আশ্রয় দেওয়ার পর ফিরিয়ে দেওয়ার নজির নেই। আর দিলেও বন্ধু বা প্রতিবেশীদের কাছে ভালো বার্তা যাবে না। তৃতীয়ত, বন্দি বিনিময় চুক্তির মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কাউকে ফেরত দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে, আমরা বলে দিতে পারি, শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না।”

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দমন-পীড়ন চালানোয় ক্ষমতাচ্যুত এই নেত্রীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আদালত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, তিনি ছাত্র বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা ‘একেবারে সুস্পষ্ট'। ভারতেও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান রয়েছে। দেশটি একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে রায়ের বিষয়টি পর্যবেক্ষণের কথা জানায় এবং বাংলাদেশের ‘সব পক্ষের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকার' অঙ্গীকার করেছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা ছিলেন ভারতের সবচেয়ে অটল আঞ্চলিক মিত্রদের একজন। তার সরকার ভারতবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে দমনে সহায়ক ছিল, যারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করতো।

যে কারণে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন

২০১৩ সালের প্রত্যর্পণচুক্তিতে বলা আছে, কোনো পক্ষ অনুরোধ করলে দুই দেশকেই সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে কি চুক্তি অনুযায়ী ভারতকে হাসিনাকে ফেরত পাঠাতেই হবে?  চুক্তিতে এমন একটি ধারা আছে, যেখানে বলা হয়েছে, অপরাধ যদি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' হয়, তবে প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। যদিও সেখানে আরো বলা আছে যে, হত্যা, খুন, ইচ্ছাকৃত হত্যা ইত্যাদি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপরাধ' হিসেবে গণ্য হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা এই অপরাধগুলোয় সরাসরি জড়িত - এটা প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। ভারত আরও যুক্তি দিতে পারে যে, হাসিনার বিচার সুষ্ঠু হয়নি এবং আইসিটি বেআইনি ও অসাংবিধানিক।

এর মূল কারণ হলো, ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পরিবারের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত সমর্থন করেছিল, যেখানে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ হাসিনার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালে মুজিবের হত্যার পর হাসিনা ও তার বোন ভারতে আশ্রয় পান এবং সেখানে ছয় বছর অবস্থান করেন। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হলো, হাসিনার শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে গড়ে ওঠা দৃঢ় রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক। বাংলাদেশে অবস্থানকারী ইসলামপন্থি সংগঠন ও ভারতবিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান দিল্লিতে প্রশংসিত হয়েছিল।

সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কোনোভাবেই শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা সম্ভব নয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে ফেরত দেয় না সভ্য কোনো দেশ। আর ট্রাইব্যুনালের এই বিচারকে ভারত ভালোভাবে নেয়নি। সেটা তাদের কথাতেই স্পষ্ট। আবার দেখুন, বৃহস্পতিবার যে মামলায় শেখ হাসিনার কারাদণ্ড দেওয়া হলো, সেখানে বলা হচ্ছে শেখ হাসিনা প্লটের জন্য আবেদনই করেননি। তিনি যখন আবেদন করেননি, তখন তার সাজা হয় কিভাবে? ফলে এই বিচার নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।”

তবে জুলাই গণহত্যার মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুটি উপায়ে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা এরই মধ্যে বলেছি, যে দু'জন আসামি পলাতক রয়েছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে রাষ্ট্র দুই ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেন। একটি হচ্ছে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত ২০১৩ সালের যে অপরাধীর বহিঃসমর্পণ চুক্তি, অর্থাৎ, এক্সট্রাডিশন ট্রিটি-২০১৩। সে চুক্তি অনুযায়ী আমাদের এখানে যেহেতু মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাদের বাংলাদেশ ভারত সরকারের কাছে ফেরত চাইবে এবং ভারত সরকার যদি আইনের শাসন ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তারা সেই আসামিদের ফেরত দেবে। বাংলাদেশে ফেরত আনার মাধ্যমে তাদের ওপরে যে সাজা দেওয়া হয়েছে, সেটা কার্যকর করা যাবে। আর দ্বিতীয় যে প্রক্রিয়া আছে, সেটি হচ্ছে, ইন্টারপোলের মাধ্যমে। যেহেতু বাংলাদেশের একটা ট্রাইব্যুনাল থেকে উপযুক্ত আদালত থেকে তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে, তাদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে এনে সেই সাজা কার্যকর করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্মিলিতভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।''

পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোর্টিশ জারির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

ভারতের ‘মনোভাব'

গত বুধবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে দিল্লিকে লেখা চিঠির জবাব এখনো আসেনি। কোন প্রক্রিয়ায় ভারতে চিঠি পাঠানো হয়েছে - জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, "নোট ভারবাল (কূটনৈতিক পত্র) আমাদের মিশনের মাধ্যমে ওদের (ভারতের) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কোনো উত্তর আসেনি। এত তাড়াতাড়ি উত্তর আশাও করি না আমরা।”

ওইদিনই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল রাজধানী নয়াদিল্লিতে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে বাংলাদেশের দেওয়া চিঠি পরীক্ষা করে দেখছে ভারত। সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জয়সোওয়াল বলেন, "চলমান বিচারিক ও অভ্যন্তরীণ আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অনুরোধটি (চিঠি) পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। আমরা শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতাসহ বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা অব্যাহতভাবে সব অংশীজনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত থাকবো।”

এ প্রসঙ্গে সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য যত প্রক্রিয়াই থাকুক না কেন, এটা ভারতের মনোভাবের উপর নির্ভর করবে। তারা যদি ফিরিয়ে দিতে না চায়, তাহলেও তাদের কাছে অনেকগুলো যুক্তি আছে। এখন অনেক দেশেই মৃত্যুদণ্ড উঠে গেছে। ফলে, কোনো সভ্য দেশ মৃত্যুদণ্ড হওয়া কাউকে ফেরত দিতে চায় না। ফলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে, কিন্তু ফিরে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।”

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব?

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিসি)-র মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এই উদ্যোগেও সাফল্যের সম্ভাবনা কতটুকু? সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের ট্রাইব্যুনালের যে আইন, সেখানে অন্য কোনো আইন কার্যকর নয়। ফলে দণ্ডবিধি বা সাক্ষ্য আইনে যা আছে, এখানে সেটা চলবে না। বিশেষ আইনে এখানে বিচার হয়েছে। এটা কি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করবে? আর ওদের আদালতে বিচার না হলে ওরা সেটা আমলে নেয় না। ফলে, এভাবে ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই।'' তিনি মনে করেন, ‘‘আইনগতভাবে আসলে সুযোগ কম। আমরা মনে করতে পরি, শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড হওয়া একজন ক্যানাডায় অবস্থান করছেন। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে ফিরিয়ে আনতে অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু ক্যানাডা মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কারণে তাকে ফেরত দেয়নি।”

প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ আইসিসির দ্বারস্থ হয়েছে। দলটির পক্ষ থেকে অন্তত ৪০০ নেতা-কর্মীকে হত্যার তদন্ত ও বিচারের আবেদন জানিয়েছে ডাউটি স্ট্রিট চেম্বারের মাধ্যমে। সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তোলা হয়েছে ড. ইউনূসসহ মোট ৬১ জনের বিরুদ্ধে। এমনিতে আইসিসি মৃত্যুদণ্ডই সমর্থন করে না। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ব্যক্তিকে তাই তাদের মাধ্যমে কোনো দেশে ফেরত পাঠানোর কোন সুযোগ নেই। আবার ভারত রোম সংবিদ্ধিতে স্বাক্ষর করেনি। চীন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ এখনো আইসিসির সদস্য হয়নি। অথচ রোম সংবিধির ৮৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শুধু সদস্য রাষ্ট্রগুলোই আইসিসির অনুরোধে সহযোগিতা করতে বাধ্য।

এসএমডব্লিউ