কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়া-ব্রিটেনের বিবাদ কোন দিকে মোড় নিতে পারে?
ইউক্রেনের কাছ থেকে দখল করে নেওয়া ভূখণ্ড ক্রিমিয়ার উপকূলে কৃষ্ণ সাগরে ব্রিটিশ নৌবাহিনী এবং রাশিয়ার বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর একটি রণতরী বুধবার ওই এলাকা দিয়ে পার হওয়ার সময় রাশিয়ার কোস্ট গার্ডের দু’টি জাহাজ এবং ২০টিরও বেশি জঙ্গিবিমান তাকে অনুসরণ করে।
রুশ প্রতিরক্ষা বিভাগ বলছে, তাদের টহল জাহাজ থেকে ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার এইচএমএস ডিফেন্ডারকে সতর্ক করে দু’টি গোলা ছোঁড়া হয় এবং জাহাজের পথের সামনে জঙ্গিবিমান থেকে একটি বোমাও ফেলা হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্য সরকার বলছে, এসব কিছুই ঘটেনি।
বিজ্ঞাপন
বিবিসির প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংবাদদাতা জোনাথান বিল তখন ওই জাহাজে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলছেন, এইচএমএস ডিফেন্ডারের ক্রুরা এই সময় লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়েছিল। এই ঘটনা নিয়ে বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষক ফ্র্যাংক গার্ডনার এক নিবন্ধে লিখেছেন, ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর উস্কানি, না সমুদ্র চলাচলে আইনগত অধিকার রক্ষার প্রচেষ্টা? এটা নির্ভর করবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
তিনি লিখেছেন, ব্রিটেন ইউক্রেনের জোর সমর্থক। তাদের যুক্তি, কৃষ্ণ সাগরে ইউক্রেনের ওডেসা বন্দর থেকে জর্জিয়ায় যাওয়ার জন্য এইচএমএস ডিফেন্ডারের ওটাই ছিল সবচেয়ে সোজা পথ।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু ওই পথটি ক্রিমিয়া উপদ্বীপের কয়েক মাইল দূর দিয়ে যায়। রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো যে ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব কখনই যা স্বীকৃত হয়নি।
মস্কোর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন
ওই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে একগাদা নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাশিয়া ক্রিমিয়াকে দেখানোর চেষ্টা করছে রুশ মাতৃভূমির সাথে একত্রীকরণের উদাহরণ হিসেবে। কারণ ক্রিমিয়ার জনসংখ্যার একটা বড় অংশ জাতিগতভাবে রুশ।
গত বুধবারের ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে তা সেভাস্টোপল বন্দরের খুব কাছে। কৃষ্ণ সাগরের এই বন্দরে রাশিয়ার একটি বড় নৌঘাঁটি রয়েছে এবং রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগর নৌবহরও এই বন্দরে নোঙ্গর করা রয়েছে।
তাই শত্রু ন্যাটো জোটের সদস্য ব্রিটেনের একটি আধুনিক ডেস্ট্রয়ার যখন ৯ হাজার ৬৫৬ কিলোমিটার দূরে নিজের বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে এমন এক জলসীমার ভেতর দিয়ে যেতে চাইছিল যাকে রাশিয়া নিজের বলে দাবি করে, তখন মস্কোর সরকার একে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করে।
সে কারণেই ডেস্ট্রয়ারটি ওই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় রুশ নৌবাহিনী বেতারের মাধ্যমে জাহাজটিকে সতর্ক করে এবং তার ওপর দিয়ে রুশ বিমানবাহিনীর জঙ্গিবিমান ঘোরাফেরা করতে থাকে।
রাশিয়ার শক্তি প্রদর্শনে ব্রিটেন কী অবাক?
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, মোটেই না। তারা গত বছরও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের ঘটনাকে খাটো করে দেখলে ভুল হবে বলে সূত্রগুলো উল্লেখ করছে। ব্রিটেন এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে।
বিশেষভাবে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউর দু’জন গুপ্তচর ২০১৮ সালে ব্রিটেনের সলসবারিতে গিয়ে সাবেক একজন রুশ গুপ্তচরকে নভিচক নার্ভ এজেন্ট বিষ প্রয়োগের ঘটনায় দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। রাশিয়া অবশ্য এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
এরও আগে আরেক গুপ্তচর অ্যালেকজান্ডার লিটভিনেনকোর ওপর তেজস্ক্রিয় পোলোনিয়াম দিয়ে হামলা, রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর সাইবার হামলা— ইত্যাদি ঘটনায় দু’টি দেশের মধ্যে বিশ্বাসের মাত্রা এখন শূন্যের কোঠায়।
ব্রিটিশ সরকারের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে রাশিয়াকে সে দেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সামরিক হুমকি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটা মনে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে ইউক্রেইনের পুরোটা, কৃষ্ণ সাগর এবং ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে রাশিয়া তার ব্যাক ইয়ার্ড বা বাড়ির পেছনের উঠান বলে মনে করে।
রুশ গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির সাবেক কর্নেল ভ্লাদিমির পুতিন তাই যতদিন ক্রেমলিনের ক্ষমতায় আসীন থাকবেন— ততদিনই পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাকাপাকি এক সন্দেহ বজায় থাকবে।
মাত্র ৩০ বছর আগেও রাশিয়া ছিল বিশাল সোভিয়েত সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে। এর সাথে যুক্ত ছিল পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত ওয়ারস জোট। এ দুটি মিলিয়ে সোভিয়েত প্রভাব বলয় জার্মানির সীমান্ত থেকে শুরু করে আফগানিস্তানকে ছাড়িয়ে যেত।
কিন্তু এখন পোল্যান্ড কিংবা বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী অনেকগুলো দেশ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে ন্যাটোতে যোগদান করেছে। তাই রাশিয়া মনে করছে, শত্রুরা চারিদিক থেকে তাকে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে এবং তার বিপদ বাড়ছে।
সে জন্যেই বুধবারের ঘটনাটি দেখতে যতটাই নাটকীয় লাগুক না কেন, ভবিষ্যতে এটা বড় কোন নাটকের ড্রেস রিহার্সাল হতে পারে।
ব্রিটিশ নীতিতে পরিবর্তন
এইচএমএস ডিফেন্ডার আসলে ব্রিটেনের বিমানবাহী নৌবহর এইচএমএস কুইন এলিজাবেথের একটি অংশ— যা সাধারণত আক্রমণভাগে থাকে। এ মাসের গোড়াতে বিশাল এই নৌবহরটি যখন ভূমধ্যসাগরে মহড়া চালাচ্ছিল, তখন এইচএমএস ডিফেন্ডারকে নির্দেশ দেয়া হয় দলছুট হয়ে কৃষ্ণ সাগরের দিকে এগিয়ে যেতে।
সরকারের সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনা অনুযায়ী, ব্রিটেনের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা নীতির মূলমন্ত্র এখন অগ্রভাগে থাকা। তারই অংশ হিসেবে রাজকীয় নৌবাহিনীর আক্রমণকারী অংশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সাউথ চায়না সির দিকে এগিয়ে যেতে।
এলাকার কিছু দেশের সাথে মিলে ব্রিটিশ নৌবাহিনী ওই এলাকার ওপর চীনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। চীন ওই সাগরে কিছু কৃত্রিম প্রবাল প্রাচীর গড়ে তুলেছে, সেগুলোকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে চীনা বিমান বাহিনী এবং কোস্ট গার্ড প্রায়ই ওই জলপথ ব্যবহার না করার জন্য অন্য দেশের জাহাজগুলির প্রতি হুঁশিয়ার সঙ্কেত পাঠায়। কারণ বেইজিং সরকার মনে করে ওই এলাকা তাদের জলসীমার অংশ।
পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা ওই অঞ্চলের কিছু দেশ, এই দাবি মানতে নারাজ। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের এক রায়ও চীনের এই দাবিকে খারিজ করে দিয়েছে। তাই ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজ যখন সাউথ চায়না সিতে পৌঁছাবে তখন চীনের কী প্রতিক্রিয়া হবে, তা দেখার জন্য শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় বসে আছেন অনেকেই।
এসএস