কানাডার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন, ১ জুলাই অন্তত ১০ টি গির্জায় হামলা- ভাঙচুর চালানো হয়েছে। দেশটির আলবার্টা রাজ্যের ক্যালগেরি শহরে ঘটেছে এই ঘটনা। স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজন এই হামলা চালিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

আলবার্টার পুলিশ ও রাজ্য প্রশসানের কর্মকর্তারা বিবিসিকে এই তথ্য জানিয়েছেন। ক্যালগেরি পুলিশ বিভাগ জানিয়েছে ৩০ জুন মধ্যরাত এবং ১ জুন ভোরের মধ্যে ঘটেছে এই ভাঙচুরের ঘটনা।

ক্যালগেরি পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানান, সম্প্রতি কানাডার বিভিন্ন প্রদেশে দেশটির আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান, ইনুইট ও মেটিস জাতিগোষ্ঠীর দেহাবশেষ ও গণকবরের সন্ধান পাওয়ার জেরে শহরের বিক্ষুব্ধ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজন এই হামলা চালিয়েছেন। ভাঙচুরের পাশাপাশি গির্জাগুলোর দরজা-জানালায় আদিবাসীরা হাতের রঙীন ছাপও দিয়েছেন, যাকে তাদের বিক্ষোভের প্রতীক বলে উল্লেখ করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। 

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জেসন কেনি এক বার্তায় এ ঘটনাকে ‘ভয়াবহ’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘ক্যালগেরিতে যেসব গির্জা ভাঙচুর করা হয়েছে, সেগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল অভিবাসীরা, যারা নিজ দেশে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারত না। এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।’

পাশাপাশি, ভাঙচুরের এ ঘটনায় খেদ প্রকাশ করে জেসন কেনি বলেন, ‘অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে অন্যায় করে গেছেন, তার ফল এখন আমাদের ভুগতে হচ্ছে। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো নই। আমরা ঐক্য চাই, পারস্পরিক শ্রদ্ধা চাই, পুনর্মিলন চাই।’

গত মে মাসে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যের একটি আবাসিক স্কুলে ২১৫ জন শিশুর দেহাবশেষে উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল দেশটিতে। তারপরের জুন মাসে কানাডার সাসকাচুয়ান, অ্যালবার্টা ও ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় কয়েক শ’ গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব অঞ্চলের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষজনকে হত্যার পর এই গণকবরগুলোতে তাদের মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। কানাডার আদিবাসী অধিকার সংস্থা দ্য ফেডারেশন অব সোভারিজিন ইন্ডিজেনাস নেশনস দেশটির সরকারের প্রতি এ বিষয়ক আরও বিস্তিৃত অনুসন্ধানের দাবি জানিয়েছে।

সংস্থাটির বক্তব্য, ঠিকমতো অনুসন্ধান করা হলে কানাডাজুড়ে এমন আরও বহু গণকবরের সন্ধান পাওয়া যাবে।

পঞ্চদশ শতকে স্পেনীয় অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন, তখন তিনি ভুলক্রমে ভেবেছিলেন যে ভারতে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান’ হিসেবে।

গায়ের রঙে লালচে ভাব থাকায় সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয় আদিবাসীদের ‘রেড ইন্ডিয়ান’ জাতি নামেই চিনে আসছে বিশ্ববাসী।

দেশটির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন কানাডায় দলে দলে ইউরোপীয় বসতকাররা (সেটলার) আসতে থাকে তখন স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান, ইনুইট ও মেটিস গোত্রসমূহের সঙ্গে তাদের বেশ কিছু সংঘাত হয়েছিল। ইউরোপীয় বসতকারদের হাতে উন্নত অস্ত্র ও প্রযুক্তি থাকায় সবগুলো সংঘাতেই শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল রেড ইন্ডিয়ানদের।

পরাজিত রেড ইন্ডিয়ানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছিল বসতকাররা। বাকি যারা বেঁচে ছিলেন, তাদের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষাদান ও ‘অধিকতর সভ্য’ করে তুলতে ১৮২৫ সালের মাঝামাঝি থেকে দেশটির প্রধান ক্যাথলিক গির্জার অধীনে কানাডাজুড়ে বিভিন্ন আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা শুরু হয়।

দেশটির আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সে সময় দেশটিতে ১৩৯ টি এ রকম আবাসিক স্কুল ছিল। ক্যাথলিক খ্রিস্টান মিশনারিরা এই স্কুলগুলো পরিচালনা করতেন।

কানাডার রেড ইন্ডিয়ান, ইনুইট ও মেটিস জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের জোর-জবরদস্তি করে ভর্তি করা হতো এইসব আবাসিক স্কুলে। সেখানে শিশুদেরকে ব্যাপকভাবে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপন নিয়ে কটাক্ষ ও ব্যাঙ্গ করাও ছিল সেই স্কুলগুলোর নিমিত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ।

দেশটির আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৩১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত চালু ছিল এ ধরনের আবাসিক স্কুল; আর এই ১৬৫ বছরে প্রায় দেড়লাখ আদিবাসী শিশুকে জোরপূর্বক পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে এসব আবাসিক স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল।

মে মাসে ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যে এমনই একটি স্কুল থেকে উদ্ধার হয়েছিল ২১৫ শিশুর দেহাবশেষ। স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৩০ সালে। ১৯৮৭ সালে সেটি বন্ধ ঘোষণা দেশটির সরকার।

কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার যদিও দেশের ইতিহাসের এই অন্ধকারচ্ছন্ন অধ্যায়ের জন্য ২০০৮ সালে আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে, কিন্তু এসব আবাসিক স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে যে প্রতিষ্ঠানের হাতে ছিল, সেই প্রধান ক্যাথলিক চার্চ এখন পর্যন্ত এজন্য ক্ষমা বা দুঃখ প্রকাশ করেনি।

সূত্র: বিবিসি

এসএমডব্লিউ