২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নৌকায় করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পেরোনোর পর ক্লান্ত নারী রোহিঙ্গা শরণার্থীর এই ছবিটি তুলেছিলেন দানিশ সিদ্দিকী। বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া এ ছবির জন্য পরের বছর পুলিৎজার পুরস্কার পান তিনি

আফগানিস্তানের কান্দাহারে নিরাপত্তা বাহিনী এবং তালেবান জঙ্গিদের সংঘর্ষের সময় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রয়টার্সের প্রধান আলোকচিত্র সাংবাদিক পুলিৎজার পুরস্কার-জয়ী দানিশ সিদ্দিকী শুক্রবার মারা গেছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের প্রধান একটি সীমান্ত ক্রসিংয়ের কাছে তালেবানের হামলায় হেরে যাওয়া এই আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় আর ধরা পড়বে না সংবাদ গল্পের কোনো ছবি।

২০১০ সাল থেকে রয়টার্সের হয়ে কাজ করে আসা ভারতীয় এই আলোকচিত্র সাংবাদিক আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধ, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট, হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীদের বিক্ষোভ এবং নেপালের সর্বনাশা ভূমিকম্পের মতো নানা ঘটনা ফ্রেমবন্দি করেছিলেন।

রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করে ২০১৮ সালে ফিচার আলোকচিত্রে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল রয়েটার্সের যে দলটি, সিদ্দিকী সেই দলের অংশ ছিলেন।

এখানে তার কিছু বাছাইকৃত কাজের গল্প তুলে ধরা হলো:

নিজের আলোকচিত্রী জীবনের সর্বশেষ যে ছবিটি তুলেছিলেন সিদ্দিকী; সেখানে দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশের একটি তল্লাশি চৌকিতে তালেবান যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছেন আফগান বিশেষ বাহিনীর একজন সদস্য। সিদ্দিকী চলতি সপ্তাহের শুরু থেকেই কান্দাহারে আফগান বিশেষ বাহিনীর সাথে সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

গত এপ্রিল এবং মে মাসে ভারতের শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের নির্মম চিত্র তুলে এনেছিলেন তার ক্যামেরার ফ্রেমে। গত ১৫ এপ্রিলের এই ছবিতে দেখা যায়, দিল্লির বৃহত্তম করোনা হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন।

দানিশ সিদ্দিকীর তোলা নয়াদিল্লির জনবহুল বসতির পাশের এক শ্মশানে গণ শেষকৃত্যের এই ছবি ভাইরাল হয়েছিল। দিনরাত অবিরাম জ্বলে চলা চুল্লি এবং শ্মশানে মরদেহ রাখার জায়গা ফুরিয়ে আসার গল্প করোনায় ভারতে অজ্ঞাত ও অপ্রকাশিত মৃত্যুর চিত্র তুলে ধরেছিল সিদ্দিকীর ছবি।

কোভিড-১৯ এ স্বামীর মৃত্যুর পর দিল্লির একটি মর্গের বাইরে শোকাহত এক মাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেন সন্তানরা।

করোনার মর্মান্তিক চিত্র তুলে আনতে ভারতের ছোট শহর এবং গ্রামে গ্রামে ঘোরেন সিদ্দিকী। পাহাড়ি রাজ্য উত্তরাখণ্ডে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ভাগ্নিকে কোলে তুলে স্থানীয় একটি ওষুধের দোকানে নিয়ে যাওয়ার এই চিত্র ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন তিনি।

গত বছরের এপ্রিলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধে দেশজুড়ে লকডাউন জারির পর ভারতের শহরগুলো থেকে লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিকের বাড়িতে ফেরার ছবি তুলেছিলেন সিদ্দিকী।

সারাদিন নারী, পুরুষ এবং শিশুদের গ্রামে ফেরার সেই যাত্রার ছবি তাদের নির্মম কষ্টের গল্প তুলে ধরেছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খাবার, পানি এবং পোশাক প্ল্যাস্টিক ব্যাগে ভরিয়ে অভিবাসী শ্রমিকদের সেই যাত্রা ছিল অত্যন্ত কষ্টের। তরুণদের পিঠ-মাথায় ছিল ভরা ব্যাগ। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত শিশুদের কাঁধে তুলে নিয়ে যাত্রা করেন বাবা-মায়েরা।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অভিযানের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন; সেই দৃশ্যও বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন সিদ্দিকী তার ক্যামেরায়।

সামরিক অভিযানের মুখে রোহিঙ্গারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে পাড়ি জমান। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সেই অভিযানকে পাঠ্যপুস্তকীয় জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে অভিহিত করে জাতিসংঘ।

ওই বছরের সেপ্টেম্বরে নৌকায় করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পেরোনোর পর ক্লান্ত নারী রোহিঙ্গা শরণার্থীর ওই ছবিটি তুলেছিলেন সিদ্দিকী। বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া এ ছবির জন্য পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পান তিনি।

পাক-আফগান সীমান্ত ক্রসিংয়ের কাছে তালেবানের হামলায় হেরে যাওয়া সিদ্দিকীর ক্যামেরায় আর ধরা পড়বে না সংবাদ গল্পের কোনও ছবি

সূত্র: বিবিসি।

এসএস