ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ছেলে জয় শাহের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যে সাংবাদিক করেছিলেন; ইসরায়েলের এনএসও সংস্থার তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার কাজে লাগিয়ে আড়িপাতা হয়েছে তার ফোনেও। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারের ওই প্রতিবেদকসহ দেশটির অন্তত ৩৮ জন সাংবাদিকের ফোন এই আড়িপাতার নিশানা হয়েছিল।

আড়িপাতার তালিকায় রোহিনী সিং নামের দ্য ওয়্যারের ওই সাংবাদিক ছাড়াও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সুশান্ত সিংহের নামও আছে। এছাড়া ভারতীয় যেসব সাংবাদিকের নাম আড়িপাতার তালিকায় এসেছে তারা বিভিন্ন সময়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের সমালোচনা করেছিলেন।

ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপের তৈরি স্পাইওয়্যার সফটওয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্মার্টফোনে আড়িপাতার ঘটনা ফাঁস হয়েছে। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হাতে সম্প্রতি একটি এ সংক্রান্ত একটি ডাটাবেস পৌঁছেছে, যেখানে ৫০ হাজারেরও বেশি ফোন নম্বরের একটি তালিকা রয়েছে।

বিশ্বের প্রথম সারির মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের ফোন নম্বর এগুলো। এই তালিকা হাতে পাওয়ার পর গার্ডিয়ান, দ্য ওয়্যারসহ ১৬ টি পত্রিকাকে এই তথ্য জানায় ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃপক্ষ।

ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যম বলছে, পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা-নেত্রী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী-সহ দেশটির কমপক্ষে ৩৮ জন সাংবাদিকের ফোনে আড়িপাতা হয়েছে। তবে সব ফোনের ফরেন্সিক পরীক্ষা এখনও হয়নি। ওই তালিকায় রয়েছে ‘হিন্দুস্তান টাইমস’, ‘ইন্ডিয়া টুডে’, ‘নেটওয়ার্ক ১৮’, ‘দ্য হিন্দু’ এবং ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’র সাংবাদিকরা।

অমিত শাহের পাশাপাশি ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির-ঘনিষ্ঠ’ ব্যবসায়ী নিখিল মার্চেন্টের কারবার এবং ব্যবসায়ী অজয় পিরামলের সঙ্গে মোদি-মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পীযূষ গয়ালের লেনদেন নিয়েও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদক রোহিনী।

দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ সালে ঠিক যে সময়ে রাফাল যুদ্ধবিমান নিয়ে ভারতজুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, ঠিক সেই সময়ই ফাঁস হওয়া তালিকায় নাম উঠেছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সুশান্তের। গত বছরই ফরেন্সিক পরীক্ষায় তার ফোনে পেগাসাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। সুশান্তও রাফাল কাণ্ডে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করছিলেন।

পেগাসাস কী

ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ পেগাসাস নামে এই স্পাইওয়্যার সফটওয়্যার তৈরি করেছে, যা আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ঢুকে ব্যবহারকারীর মেসেজ, ছবি, ইমেইল পাচার করতে যেমন সক্ষম, তেমনি কল রেকর্ড এবং গোপনে মাইক্রোফোন চালুও রাখতে পারে।

২০১৬ সালে এনএসও গ্রুপ এই সফটওয়্যার প্রথম প্রস্তুত করে, তবে তখন তার নাম ছিল কিউ সুইট, পরে তা পরিবর্তন করে নাম দেওয়া হয় ট্রাইডেন্ট এবং তারও পরে নামকরণ হয় পেগাসাস।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি ল্যাব পরিচালনাকারী ক্লডিও গুয়ারনিয়েরি গার্ডিয়ানকে বলেন, “যদি কোনো ফোনে (স্মার্টফোন) পেগাসাস সফটঅয়্যারটি ঢোকানো যায়, তবে এনএসওর গ্রাহক পুরো ফোনটির দখলই পেয়ে যাবে।

‘ফোনের মালিকের মেসেজ, কল, ছবি, ইমেইল সবই দেখতে পাবে, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের বার্তাগুলোও পড়তে পারবে। গোপনে ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন চালুও করতে পারবে।”

২০১৯ সাল থেকে সীমিত পরিসরে এই সফটওয়্যার বিক্রি শুরু করে এনওএস গ্রুপ। প্রাথমিক অবস্থায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোই ছিল এর প্রধান ক্রেতা। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার বৈধ লাইসেন্সের মাধ্যমে ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, বর্তমান বিশ্বে অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যার সফটওয়্যারগুলোর মধ্যে পেগাসাসকে সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করা হয়।

পেগাসাস প্রজেক্ট

গার্ডিয়ান তার প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া ডেটাবেইসে ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসওর গ্রাহকরা এদের বিষয়ে তৎপর ছিল এবং ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’ দৃঢ়ভাবে মনে করে যে এনএসওর গ্রাহক সরকারগুলোর লক্ষ্যবস্তু ছিল ওই নম্বরগুলো।

এই নম্বরগুলোর কিছু ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষায় অর্ধেকের বেশিগুলোতে পেগাসাস সফটওয়্যারের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে গার্ডিয়ান জানিয়েছে।বিশ্বজুড়ে নজরদারির মুখে থাকা এই ব্যক্তিদের মধ্যে কারা কারা রয়েছে, তাদের নাম অচিরেই প্রকাশ করবে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’।

এই ব্যক্তিদের মধ্যে সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, বিরোধী রাজনীতিক ছাড়াও ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ফোন নম্বরও রয়েছে। কোনো কোনো রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের ফোন নম্বরও থাকার কথা জানিয়ে গার্ডিয়ান লিখেছে, ক্ষমতাবানরা তাদের স্বজনদের উপরও গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

রোববার এই তালিকা প্রকাশ শুরুর পর ১৮০ জন সাংবাদিকের ফোন নম্বর পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সিএনএন, রয়টার্স, নিউ ইয়রক টাইমস, এপি, ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাংবাদিক রয়েছে। ৪৫টি দেশের ফোন নম্বর পাওয়া গেছে ওই তালিকায়, তার মধ্যে ১ হাজারের বেশি নম্বর ইউরোপের দেশসমূহের।

এসএস