দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পরাধীনতা থেকে বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ঠিক পরের বছরই ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।

তবে স্বাধীনতা অর্জনের পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নতি পাকিস্তানের চেয়ে ভালো, সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর রাইটস অ্যান্ড সিকিউরিটি (ইফ্রাস)। কানাডার টরেন্টোভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি গত ৩০ জুলাই প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই মন্তব্য করে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান - সাবেক একক দেশ, এখন এক বিশ্ব ব্যবধান’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে ইফ্রাস গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ কীভাবে ‘অনন্য একটি দেশে’ পরিণত হয়েছে এবং এর বিপরীতে পাকিস্তানের ‘বিপর্যয়ের গল্প’ তুলে ধরেছে।

চলমান শতাব্দীর অদৃশ্য বহু চ্যালেঞ্জের মধ্যেও করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ অত্যন্ত ভালো সফলতা দেখিয়েছে মন্তব্য করে ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর রাইটস অ্যান্ড সিকিউরিটি বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। বহুপাক্ষিকতা এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতাও রক্ষায়ও মোকাবিলা করতে হচ্ছে অভূতপূর্ব নানা চ্যালেঞ্জ। এর ফলে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য খাতে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়ছে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো।

ইফ্রাস বলছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বরাবরই পাকিস্তানের চেয়ে ভালো ছিল। এমনকি করোনা মহামারি শুরুর আগেও এই হারে পাকিস্তানের ওপরেই ছিল বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, বিপরীতে পাকিস্তানের হার ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।

টরেন্টোভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান বলছে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার ব্যবধান এখন অনেক বেশি। কারণ দু’টি দেশই তাদের জাতীয় স্বার্থের কথা ভিন্ন ভাবে উপলব্ধি করে। বাংলাদেশ মনে করে, মানব উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যেই দেশের ভবিষ্যৎ রয়েছে। এ কারণে রফতানি বৃদ্ধি, বেকারত্বের হার কমানো, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তার ওপর নির্ভরতা কমানো এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের বিস্তারসহ দেশটি টেকসই উন্নয়নের বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

ইফ্রাস’র তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের জন্য মানবাধিকার বা মানব উন্নয়নের গুরুত্ব অনেক পরে, দ্বিতীয় ধাপে। দেশটির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, ভারতকে প্রতিরোধ করা এবং বাইরের দেশগুলোতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থাকে সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে গড়ে তোলা।

এদিকে করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ছুঁয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫১০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে চলতি বছরের জুন মাসে পাকিস্তানের রিজার্ভ মুদ্রার পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭১০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের তুলনায় যা অর্ধেকেরও কম।

ইফ্রাস বলছে, করোনা মহামারি শুরুর পর লকডাউনসহ নানা কারণে ২০২০ অর্থবছরে বিশ্বের প্রায় সকল দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে এই সময়েও বাংলাদেশ ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়। এছাড়া ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৫৪৩ মার্কিন ডলার।

টরেন্টোভিত্তিক বৈশ্বিক এই থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান বলছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি ধনী ছিল পাকিস্তান। অন্যদিকে ৫০ বছর পর এসে পাকিস্তানের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ২৭১ গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

স্বাধীনতার পর মাত্র দুই দশকের মধ্যেই অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। তবে গত ২০ বছরের বেশি সময়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৫০০ শতাংশ, যা পাকিস্তানের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তুলা উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও বাংলাদেশে এখন হাজার হাজার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রয়েছে। মাত্র কয়েক মিলিয়ন ডলারের তুলা আমদানির পর পোশাক তৈরি করে ৩ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রফতানি করছে বাংলাদেশ।

বিপরীতে তুলা উৎপাদনকারী দেশ হয়েও গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল পণ্য রফতানি বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তান। এই খাতে দেশটির রফতানি এক হাজার কোটি মার্কিন ডলারেরও কম। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে পাকিস্তান এখন তুলা আমদানিও করে থাকে।

ইফ্রাস বলছে, সামন্ততান্ত্রিক ও উপজাতীয় কাঠামোর কারণে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের মধ্যে নতুনত্ব ও অঙ্গীকারের অভাব রয়েছে। এ কারণেই দেশটি কৃষি সম্পদের, বিশেষ করে উৎপাদিত তুলার সদ্ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে পাকিস্তানে উৎপাদিত পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্যের রফতানিও বাড়ছে না।

টিএম