আফগান শরণার্থী ঠেকাতে সীমান্তে কড়াকড়ি তুরস্কের
আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে দেশটি থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষ সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে ছুটছেন। শরণার্থীর এই ঢল ঠেকাতে ইরানের সঙ্গে সীমান্তবর্তী ভ্যান প্রদেশে নিরাপত্তা জোরদার করেছে তুরস্ক।
সোমবার বার্তাসংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আফগানিস্তান থেকে ইরানের প্রবেশের পর অনেক আফগান শরণার্থী ইরান-তুরস্ক সীমান্ত এলাকায় ছুটছেন। তাদের লক্ষ্য- কোনোভাবে তুরস্কে প্রবেশ করা।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু সীমান্তের কাছাকাছি গিয়ে তারা দেখতে পাচ্ছেন, গোটা সীমান্ত এলাকা প্রায় ১০ ফুট (তিন মিটার) উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত এবং বেড়ার অপর প্রান্তে, তুরস্কে বিপুল সংখ্যক সীমান্তরক্ষী বাহিনী টহল দিচ্ছে।
ইরান-তুরস্ক সীমান্তবর্তী তুরস্কের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ ভ্যানের গভর্নর এমিন বিলমেজ এ প্রসঙ্গে রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা বিশ্বের সামনে এই চিত্র তুলে ধরতে চাই যে, আমাদের সীমান্ত দুর্ভেদ্য ও এটি অতিক্রম করে তুরস্কে প্রবেশ করা অসম্ভব। আফগান শরার্থীদের ঢেউ ঠেকাতে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কড়াকড়ি আনতে আমরা বাধ্য হয়েছি।’
বিজ্ঞাপন
তুরস্কের সরকারি প্রশাসনের একাধিক জ্যেষ্ঠ্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ সিরীয় শরণার্থী এবং ১ লাখ ৮২ হাজার নিবন্ধিত আফগান শরণার্থী অবস্থান করছেন, অনিবন্ধিত শরণার্থী আছেন আরো প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। অনিবন্ধিত শরণার্থীদের বেশিরভাগই কারাবন্দি অবস্থায় আছেন।
এছাড়া ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপীয় দেশসমূহে যেতে তুরস্ককে ব্যাবহার করেন অনেক অভিবাসন প্রত্যাশী। তাদেরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কারাগারে বা কোনো না কোনো শরণার্থী শিবিরে আছেন।
দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ইতমধ্যে ইউরোপীয় দেশগুলোর উদ্দেশে বলেছেন, আফগানিস্তানের শরণার্থীদের ব্যাপারে ইউরোপের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত এবং ইউরোপের ‘শরণার্থী কেন্দ্র’ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাওয়ার কোনো ইচ্ছা তুরস্কের নেই।
২০১৯ সাল থেকে তুরস্কে আসতে শুরু করেন আফগান শরণার্থীরা। দেশটিতে বর্তমানে যে তিন লক্ষাধিক আফগান শরণার্থী আছেন, তাদের সবাই এসেছেন ২০১৯ ও ’২০ সালে।
তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর নতুন করে যেন শরণর্থীর ঢেউ না আসে, সেজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হলেও সেটি যে খুব কার্যকর হবে এমন প্রত্যাশা অবশ্য তুরস্কের সরকারও করছেন না।
এমিল বিলমেজ এ বিষয়ে রয়টার্সকে বলেন, ‘আপনি যতই সীমান্ত সুরক্ষা বা কড়াকড়ি আরোপ করুন না কেন, কিছু মানুষ তা ভেদ করে ঠিকই তুরস্কে প্রবেশ করবে। তবে আমরা আমাদের নীতিতে অটল আছি।’
তার এই কথার সত্যতা পাওয়া গেছে রয়টার্সের অনুসন্ধানে। সীমান্ত এলকায় কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও ইরান-তুরস্ক সীমান্ত দিয়ে কিছু সংখ্যক আফগান তুরস্কে প্রবেশে সক্ষম হয়েছেন। শনিবার ভ্যান প্রদেশের হাকিবেকির এলাকার একটি অপরিচ্ছন্ন, জীর্ণ ভবন থেকে ২৫ জন অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেফতার করেছে তুরস্কের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছেন, মানবপাচারকারীর মাধ্যমে তুরস্কে প্রবেশ করেছেন তারা। গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিকভাবে একটি শরণার্থীকেন্দ্রে রাখা হয়েছে। সেখানেই রয়টার্সের সঙ্গে কথা হয় তাদের কয়েকজনের।
গ্রেফতার অনুপ্রবেশকারী জয়নুল্লাহ (২০) রয়টার্সকে জানান, তুরস্কে প্রবেশের জন্য ইরানে প্রবেশের পর ৮০ দিন পায়ে হেঁটে সীমান্তে পৌঁছেছিলেন তিনি। গ্রেফতার হওয়ার দুই দিন আগে মানবপাচারকারীর মাধ্যমে তুরস্পে প্রবেশে সক্ষম হন।
রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, এখানে আমরা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাব। আমরা এখানে উপার্জন করতে পারব এবং বাবা-মা, অভিভাবকদের টাকা পাঠাতে পারব। ওখানে থাকলে তালেবানরা আমাদের মেরে ফেলবে।’
হাকিবেকির এলাকার ওই ভবন থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ গ্রেফতার হয়েছেন সৈয়দ ফাহিম মৌসাভি (২৬)। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর গাড়িচালক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। এক মাস আগে সপরিবারে কাবুল ত্যাগ করেন।
তার স্ত্রী মোরসাল (২২) রয়টার্সকে বলেন, ‘তারা (তালেবান) নিষ্ঠুর। তারা বাড়ি বাড়ি ঢুকে নারীদের ধর্ষণ করে, তারপর করে হত্যা। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের শিরোচ্ছেদ করে।’
‘আমরা আর ফিরে যেতে চাই না। আমাদের এখানে থাকতে দিন।’
তুরস্ক সরকারের অভিবাসী ব্যবস্থাপনা দফতরের উপ পরিচলক রামাজান সেকিলমিস বলেছেন, দেশটির সরকার সম্প্রতি কারা প্রকৃত শরণার্থী ও কারা অভিবাসন প্রত্যাশী, তা খতিয়ে দেখছে।
রয়টার্সকে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যারা নিরাপত্তার জন্য তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন এবং যারা অভিবাসনের প্রত্যাশায় এখানে প্রবেশ করেছেন তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে এবং আমরা সেটি খতিয়ে দেখছি।’
‘আফগান নাগরিক- কেবল এই কারণে আমরা তাদের বিতাড়িত করতে পারি না।’
সূত্র : রয়টার্স
এসএমডব্লিউ