দীর্ঘ দুই দশকের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ৩১ আগস্ট (মঙ্গলবার) গভীর রাতে সৈন্য প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই আফগানিস্তান থেকে নিজেদের শেষ সৈন্য ও কূটনীতিককে কাবুল থেকে দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সৈন্য প্রত্যাহারের এই প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনার মধ্যেই সেনা প্রত্যাহারের একদিন পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

বাইডেন বলেছেন, যুদ্ধ শেষ করার এই সিদ্ধান্তের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তাকে মনে রাখবে এবং যেভাবে এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি আমাদের সামনে তুলে ধরেছে।

উত্তর আমেরিকায় বিবিসির সংবাদদাতা অ্যান্থনি জুরকার যেমন লিখেছেন, গত দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র যে একটি দেশ দখল করে সেটি পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করে আসছিল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘সেই পাতা উল্টে’ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

সাংবাদিক জুরকার আরও লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে তিনি নতুন করে সাজাতে চেষ্টা করছেন। সামরিক বাহিনী মোতায়েনের বদলে তিনি বরং কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর জোর দিতে চান।’ 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আলী রীয়াজ এ প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে ইতোমধ্যেই পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাড ট্রাম্প এককভাবে কাজ করতেন, যা এখন আর নেই।

তিনি আরও বলেন, এখন গোটা বিশ্বে বিভিন্ন রকম শক্তির উত্থান ঘটেছে। চীনের উত্থান হয়েছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে রাশিয়ার উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এই বাস্তবতার নিরিখেই এখন যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করছে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রীয়াজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ৬০-এর দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যেভাবে আচরণ করে আসছে, সারা বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের নতুন বাস্তবতার কারণে সেখানে পরিবর্তন আনতে হচ্ছে।’

সাউথ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক শফিকুর রহমান বিবিসিকে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘একলা চলো’ নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব নিয়ে ইউরোপ ও ন্যাটো বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখন সেখানে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘তারা বুঝতে পারছিল না যে কোথায় যাবে। জার্মানি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক করছিল। ইসরায়েল সম্পর্ক গড়ে তুলছিল চীনের সঙ্গে। এ রকম একটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজেদের বের করে আনার চেষ্টা করছেন।

সামরিক বিমানে উঠছেন আফগানিস্তানের মাটিতে থাকা শেষ মার্কিন সেনা।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আরও বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে এখন অন্য বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আফগানিস্তান যুদ্ধ শেষ হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন চীন ও রাশিয়ার ব্যাপারে আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারবে।

জো বাইডেন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বদল আনার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করা। ২০০১ সালের হুমকির বিরুদ্ধে নয়, বরং ২০২১ সাল এবং ভবিষ্যতের হুমকি মোকাবিলা করাই তার কাজ।

তিনি বলেন, আফগানিস্তানসহ অন্যান্য দেশে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই লড়াই অব্যাহত থাকবে। তবে ‘এজন্য স্থলযুদ্ধে (অর্থাৎ কোনো দেশে সামরিকভাবে অভিযান চালানোর) যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।’

শফিকুর রহমান মনে করেন, ‘প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই। তিনি আর তিন বছর থাকবেন। এর পর কী হবে আমরা জানি না। বাকি তিন বছরে তিনি কতটুকু কী করতে পারবেন সেটাও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।’

তাহলে কী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের আগের ভূমিকা আর থাকবে না? আলী রীয়াজ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের মতোই থাকবে, তবে ভিন্ন উপায়ে।

তিনি বলেন, ‘সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর নিজেকে নেতৃত্বের আসনে রাখতে পারছে না, পারবেও না, প্রয়োজনও নেই। তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে নিজেকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে ও তার মিত্রদের সাথে নিয়ে। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব অব্যাহত থাকবে। তবে সেটি এককভাবে বা সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হবে না।’

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ১১ সেপ্টেম্বরের ওই হামলার পর থেকে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে দেশটি ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান- যেখানেই যুদ্ধে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তার কোনটিতেই তারা সফল হতে পারেনি।

আলী রীয়াজ মনে করেন, ‘এ কারণেই জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার যে ধারা তৈরি হয়েছিল সেখান থেকে তারা সরে আসবে।’ তাহলে কি সামরিক শক্তির বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সুপার-পাওয়ার ইমেজ’ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে?

এই প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরও তাই মনে করা হয়েছিল। আরও কিছু যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার পরেও এ রকম ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি ‘

তবে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই ইমেজে কোনো পরিবর্তন আসবে কীনা সেটা নির্ভর করছে বিশ্ব ব্যবস্থার বাস্তবতা অনুযায়ী দেশটি তার ভূমিকা নির্ধারণ করতে পারছে কিনা তার ওপর।’ শফিকুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘সুপার-পাওয়ার ইমেজ’ পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।

তিনি বলেন, ‘গোটা বিশ্বে আমেরিকার সম্মান, নেতৃত্ব, ব্যবসা বাণিজ্য, অভিভাবকত্ব, আমরা বড় ভাই— এই ধারণা, তাদের ওপর নির্ভর করা যায়— ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, পূর্ব এশিয়ার বহু দেশ তো তাকিয়েই থাকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। আর এসবই তো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির কারণে। এই শক্তি প্রদর্শন না করলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সেই নেতৃত্বও থাকবে না।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিগত ৭০ বছরে বিশ্বে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একটা ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে। এই ইমেজ রক্ষা করতে হলে তাকে অবশ্যই সামরিক শক্তি দেখাতে হবে। অন্যথায় সবাই মনে করবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। বাকি বিশ্বের এই ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হবে।’

এএস